লতিফুর রহমান: একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীর বিদায়

লতিফুর রহমান
লতিফুর রহমান

দুপুরের আগে আগে আমার ফোনে একটি খুদে বার্তা পেলেও অফিসের কাজের কারণে বুঝতে পারিনি। বার্তাটি ছিল শেহজী হকের, ‘আব্বু ফারাজ বাবার কাছে চলে গেছেন’, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা’। বৈঠক শেষ করতেই আমার এক সহকর্মী জানালেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজের সম্ভবত নীতি-নৈতিকতায় সবচেয়ে উচ্চকিত নাম, লতিফুর রহমান ঘুমের মধ্যে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ছোটবেলায় হুজুরের কাছে শুনেছিলাম, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর নেককার বান্দাদেরই ঘুমের মধ্যে শান্তিতে তাঁর কাছে নিয়ে যান।

তার পরও কিছুতেই মানতে পারছি না, কিছুতেই পারছি না শামীম ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নিতে। তিনি শুধু একজন ভালো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাই ছিলেন না, ছিলেন সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ, সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত। সেই ১৯৮৭ সাল থেকে পরিচয়। সেই ৫২, মতিঝিলের ট্রান্সকম অফিসে। মনে পড়ছে তাঁর ফিলিপস অধিগ্রহণ, পেপসি অধিগ্রহণ, নেসলে আর হোলসিমে আংশিক অংশগ্রহণ, ডেইলি স্টার আর প্রথম আলোর জন্য প্রথম মেশিন আর কাগজের এলসি খোলা, এমসিসিআইতে তাঁর নেতৃত্বে কাজ করা আর কত কত বৈঠক—আমার বাসায়, তাঁর বাসায়, গাড়িতে, হোটেলের লবিতে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের বাসায়, প্লেনে—মুম্বাইতে, দিল্লিতে, এমনকি আমাদের হংকং ও লন্ডন অফিসে।

আমাদের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁকে দেখতেন বিশেষ সমীহের দৃষ্টিতে। আমি নিজে দেখেছি পেপসির গ্লোবাল সিইও ইন্দ্রা নুয়ি, ইউনিলিভারের দক্ষিণ এশিয়াপ্রধান সঞ্জীব মেহেতা আর মাস্টারকার্ডের বর্তমান গ্লোবাল সিইও আর সাবেক নেসলে ও পেপসির পূর্ব ভারতীয় বিক্রয়প্রধান ও পরবর্তীকালে সিটিব্যাংক এনএ-তে আমার রিপোর্টিং সিনিয়র অজয় বাঙ্গা তাঁকে কেমন সম্মান করতেন।

তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আইবিএ ও ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের ক্লাসেও ‘বিজনেস এথিক্স’ নিয়ে কথা বলতে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে তাঁর একটি বক্তৃতার বিষয় ছিল, ‘হোয়াট উই এক্সপেক্ট ফ্রম এ গ্লোবাল ব্যাংক?’

মেয়ের শাজনীন রহমানের মৃত্যু, পরে নাতি ফারাজের মৃত্যুতে একটু টলে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভাঙেননি। শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। থাকতেন কিছুটা সবুজ পরিবেশে গ্রামের বাড়িতে।

দেশটাকে খুব ভালোবাসতেন শামীম ভাই। হোটেলের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে বলতেন, ‘তোমার গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দাও, আমি নামিয়ে দেব।’ আমার গাড়ি বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ হতো, দেশ আর ব্যবসায়ে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিয়ে। ব্যাংকের মন্দ আর বেপরোয়া ঋণ নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন। মন্দ ঋণ বারংবার পুনঃ তফশিলের কট্টর সমালোচক ছিলেন। আমাদের বলতেন, এমসিসিআই যাতে সব সময় কালোটাকা সাদা করার বিরোধিতা করে। তা না হলে সৎ ব্যবসায়ী করদাতাদের প্রতি অবিচার হয়।

এই সেদিনও তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করে খুদে বার্তা পাঠিয়েছি। আগেও খুদে বার্তায় কথা হতো প্রায়ই। চিন্তা করেছিলাম, একদিন হঠাৎ করে চৌদ্দগ্রাম চলে যাব তাঁকে দেখতে।

সর্বশেষ একসঙ্গে দুদিন কাটালাম মুম্বাইয়ের তাজ ল্যান্ডস অ্যান্ড হোটেলে। তিনি এ অঞ্চলের সেরা ব্যবসায়ী নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমি, এইচএসবিসির মাহবুব আর সিটিব্যাংক এনএর শামস বাংলাদেশ থেকে তাঁর সাথি। ওখানে ভারতের নামীদামি ব্যবসায়ীরা তাঁকে অনেক অনেক সম্মান দেখালেন। ইউনিলিভারের সঞ্জীব মেহেতা তাঁকে প্রায় পায়ে ধরে সালাম করতে চাইলেন। ব্যবসায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আর নীতিবোধ নিয়ে চমৎকার একটি বক্তব্য দিলেন তিনি।

দেশে ফিরে তাঁকে আমরা একটি সম্মাননা জানালাম। শেষ দেখা তাঁর বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের বিদায়ী নৈশভোজে। তখনই বেশ কাশছিলেন। কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। ইউরোপের বন্ধুরা নাকি তাঁকে বলেছিলেন, ফ্রান্সে বা বিলেতে একটি কান্ট্রি হাউস কিনে নির্মল পরিবেশে থাকতে। আমি বললাম ক্ষতি কী? ভালোই তো হবে। তিনি কিছুটা রেগে বললেন, ‘আমি আমার গ্রামের বাড়িতে থাকব।’

শামীম ভাই একটি কথা প্রায়ই বলতেন, ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার দরকার নেই। তাঁরা ভালো করে ব্যবসা করলেই আরও লোক কাজ পাবে আর দেশ এগিয়ে যাবে। স্ত্রীকে, সন্তানদের বিশেষ করে নাতিদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। নাতিদের সবাইকে বলতেন, ‘যেখানেই পড়তে যাও, পাস করে দেশে এসে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশই তোমাদের চূড়ান্ত ঠিকানা।’ তাঁর সঙ্গে যাঁরাই কাজ করেছেন তাঁরাই জানেন, তিনি প্রত্যেককে অনেক বিশ্বাস করতেন এবং নিজের মতো করে কাজ করতে দিতেন। নেতৃত্বের সুযোগ করে দিতেন। তাঁর কাজ ও বিশ্বাসের গুণে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ভালো ব্যবসায়ীদের প্রতীক। গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ভালো কর্মীর সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তাঁদের নিয়মিত প্রশংসা করতেন, খোঁজ নিতেন। নীতির প্রশ্নে কখনো আপস করতে দেখিনি। পারিবারিক মূল্যবোধেও ছিলেন অটল।

এত ভালো একজন মানুষ কীভাবে হঠাৎ করে চলে গেলেন? পরম দয়াশীল রহমানুর রাহিম নিশ্চয়ই তাঁর জন্য আরও ভালো ফয়সালা করে রেখেছেন।

পরিবার ও তাঁর বন্ধুদের সবার প্রতি সমবেদনা। তাঁর মতো ভালো লোকের মৃত্যু নেই, আছে শুধু ওপারে চলে যাওয়া। আমাদের সবার ভালো কাজের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন।

মামুন রশীদ: সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও পিডব্লিউসির বাংলাদেশপ্রধান।