সার্ক ভারতের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে

ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় বিশ্বজুড়ে সম্প্রসারণবাদের অংশ হিসেবে আধিপত্যবাদী চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের স্বার্থগুলোকে হ্রাস করছে। এটা নয়াদিল্লির প্রধানতম উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতার কথা ব্যাপকভাবে পরিচিত। আদর্শিক ও বৈষয়িক কারণে নেপাল চীনের সঙ্গে দিনে দিনে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। অন্যদিকে চীন তাদের বাজারে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। এটা বাংলাদেশকে কাছে টানার একটা চেষ্টা। আর প্রচুর বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। তবে ব্রুকিংস ইন্ডিয়ার এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ ভৌগোলিকভাবে ভারতের কাছে হওয়া সত্ত্বেও এখন আমদানির জন্য মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল।

সার্ক সচল করা জরুরি

বেশ কয়েকজন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিয়েছেন যে চীনের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত লেনদেন দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করতে হবে। আর এ কারণে, সার্ককে নতুন করে সচল করা জরুরি, যা ২০১৪ সাল থেকে অকার্যকর হয়ে রয়েছে। গত কয়েক বছরে, পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতার কারণে, সার্কের প্রতি ভারতের রাজনৈতিক আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভারতে সন্ত্রাসবাদের প্রসারে ভূমিকা রাখার জন্য ভারত পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অধ্যাপক এস ডি মুনির যুক্তি হচ্ছে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে এখন পর্যন্ত কোনো বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হয়নি। ভারত সার্কের বিকল্প হিসেবে বিমসটেকের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থাভুক্ত দেশগুলোতে বিনিয়োগ শুরু করে। তবে বিমসটেক সদস্যদের অভিন্ন পরিচয় না থাকায় এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের যুক্ততার অভাবে সংস্থাটি সার্কের বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তার ওপর বিমসটেকের লক্ষ্য হচ্ছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চল। ফলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে জড়িত করার ক্ষেত্রে একটি অযথাযথ ফোরামে পরিণত হয়েছে।

সার্কে প্রাণের সঞ্চার করার একটি উপায় হলো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সংহতকরণের প্রক্রিয়াটিকে পুনরুদ্ধার করা। দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সর্বনিম্ন সমন্বিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এ অঞ্চলের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হচ্ছে আন্ত–আঞ্চলিক বাণিজ্য। অন্যদিকে আসিয়ান অঞ্চলে আন্ত–আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আস্থার ঘাটতি যেকোনো অর্থবহ আন্দোলনকে বাধা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাণিজ্য–বাধা দূর করে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের আকার তিন গুণ করা সম্ভব। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ২৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। মানুষের তৈরি বাধাগুলো দূর করতে পারলে এটি ৬৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তবে এ সম্ভাবনায় প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ শুল্ক, অশুল্ক বাধা, যোগাযোগ খরচ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট।

শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা হ্রাস করার জন্য ভারতের উচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে কাজ করা। ২০০৭ সাল থেকে মুলতবি থাকা সার্ক বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করার দরকার রয়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের তথ্য অনুসারে, আসিয়ান অঞ্চলে আন্ত–আসিয়ান বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৯ শতাংশ। সার্ক অঞ্চল একইভাবে উচ্চতর আন্ত–সার্ক বিনিয়োগপ্রবাহ থেকে উপকৃত হতে পারে। গভীর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতকরণ ভারতের কেন্দ্রীয় ভূমিকা অর্জনের পাশাপাশি আরও বেশি নির্ভরশীলতা তৈরি করবে, যার ফলস্বরূপ ভারতের কৌশলগত স্বার্থও রক্ষা হবে।

অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ

সার্ক পুনরুজ্জীবিত করতে ভারত দুটি প্রধান অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রথমত, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে এবং মতাদর্শগত কারণে ভারতের মাটিতে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব ও ইসলামভীতি বা বিদ্বেষ বজায় রাখা হচ্ছে। এ–জাতীয় রাজনীতি অবাঞ্ছিত উপায়ে বিদেশনীতিকে প্রভাবিত করে। দ্বিতীয়ত, মোদি সরকারের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বোধগম্য নয়। আত্মনির্ভরতা (স্বনির্ভরতা) এবং ‘ভোকাল ফর লোকাল’–এর স্লোগানগুলোর অর্থ কী তা স্পষ্ট নয়। সরকারের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতারা দাবি করেছেন যে এসবের অর্থ পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীরা বলছেন যে ভারতকে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এসব বক্তব্য আমদানির বিকল্প হিসেবে অপ্রচলিত অর্থনৈতিক দর্শনে ফিরে আসার ইঙ্গিত দেয়। 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বছরের শুরুর দিকে সার্ক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভালো করেছেন। তবে সার্ক দেশগুলোতে টেকসই বিনিয়োগ ছাড়া এ মুহূর্তে এ ধরনের উদ্যোগ কোনো কাজেই আসবে না।

দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

প্রভাষ রঞ্জন নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী অধ্যাপক