মানব পাচার ও কুয়েতের উদ্যোগ

গত ২৫ জুন প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সাংসদসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে এ দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেদনে কোনো সাংসদ বা সরকারি কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রতীয়মান হয়, এই বক্তব্যের সঙ্গে কুয়েতে বাংলাদেশের একজন সাংসদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনার সম্পর্ক আছে। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকর একটি বিষয়। 

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে নয়, বরং নিজেই মানব পাচার ও মুদ্রা পাচারের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম। কুয়েত সরকার তাঁর বিষয়ে সে দেশের আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। কারণ, তাঁর ক্রিয়াকলাপে সেই দেশের আইন লঙ্ঘিত হয়েছে বলে তারা মনে করছে। তাঁর অপরাধবৃত্তির সঙ্গে কুয়েত সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তারা পেয়েছে এবং এ নিয়ে কুয়েতের সংসদে পর্যন্ত তোলপাড় হয়েছে। 

কিন্তু কাজী শহিদের অপরাধবৃত্তির মূল ক্ষেত্র বাংলাদেশ। তাঁর প্রতিষ্ঠান জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করেছে বাংলাদেশ থেকে। কর্মসংস্থানের আশায় বিদেশ যেতে আগ্রহী দরিদ্র মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে তাঁদের পাচার করেছে অবৈধভাবে। মানব পাচারের মতোই আরেকটি গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ মুদ্রা পাচার। কাজী শহিদ সেই অপরাধেও বছরের পর বছর ধরে লিপ্ত থেকেছেন। শুধু কুয়েত থেকে নয়, বাংলাদেশ থেকেও তিনি মুদ্রা পাচার করেছেন। 

এ দুই ধরনের গুরুতর অপরাধের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে কাজী শহীদ ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেরও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি দ্বৈত পাসপোর্ট বহন ও ব্যবহার করেন। এবার তিনি কুয়েত গেছেন সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করে, সাংসদ হিসেবে যা তাঁর কাছে থাকারই কথা নয়। সাংসদেরা কূটনৈতিক পাসপোর্ট পান এবং সেটি পাওয়ার সময় তাঁদের সাধারণ সবুজ পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। তিনি সবুজ পাসপোর্ট জমা না দিয়েই কূটনৈতিক পাসপোর্ট পেয়েছেন এবং সাংসদ থাকা অবস্থায় নিজের সুবিধামতো সময়ে উভয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে এসেছেন—এটিও একটি অপরাধ। দ্বৈত পাসপোর্ট ব্যবহার করার কারণে আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সরকারের আমলে একজন প্রতিমন্ত্রী পদচ্যুত হয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো কাজী শহিদ ইসলামের দ্বৈত পাসপোর্ট বহন ও ব্যবহার কেন অপরাধ বলে গণ্য হবে না। 

এই সাংসদের অবৈধ কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর তো বটেই, কিছু বাস্তবিক স্বার্থের জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানব পাচার আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুতর একটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তা এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয় মানব পাচারের সূচকে অবনতি ঘটলে। সাংসদ শহিদের কারণে বাংলাদেশের সামনে সে রকম ঝুঁকি দেখা দিয়ে থাকতে পারে। 

অতএব, বেশ কয়েকটি যুক্তিতে সাংসদ শহিদ ইসলামের বিষয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু ‘বিদেশে একজন সাংসদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা দেশের জন্য লজ্জাজনক’—পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া না হলে কুয়েতসহ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে এমন নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে সাংসদ শহিদের অপরাধের অভিযোগগুলো আমাদের সরকার এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু শুধু সে কারণে নয়, আমাদের জাতীয় স্বার্থে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে, সাংসদ শহিদের বিষয়ে তদন্ত ও যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।