সংবাদপত্রের এক আদর্শ উদ্যোক্তার বিদায়

লতিফুর রহমান
লতিফুর রহমান

জনাব লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে দেশ হারাল নেতৃস্থানীয় একজন সৎ, কর্মোদ্যোগী, নিষ্ঠাবান, সজ্জন শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীকে—এ কথা বারবার শোনা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা শোকবার্তায় এই কথা বলেছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু আমরা, সংবাদপত্রসেবীরা, হৃদয়ের গভীরে খুব ভালো করে জানি, দেশের সাংবাদিকতা হারাল নক্ষত্রের মতো একজন সুহৃদকে। 

নক্ষত্র কথাটা দুই অর্থে ব্যবহার করছি। এক. তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংবাদপত্রজগতের দুই শীর্ষস্থানীয় দৈনিক—প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার–এর উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের একজন। প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা দ্য মিডিয়াস্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান। তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত দুটো কাগজই শুধু পাঠকপ্রিয়তায় এগিয়ে তাই নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গুণমানের দিক থেকেও শীর্ষস্থানে। সেই অর্থে তিনি তো তারকাই। দুই. কিন্তু আরেকটা অর্থে তারকা কথাটা বলতে হবে। বহুদিন আগে, সাংবাদিকতার শিক্ষক সুব্রত শংকর ধর আজকের কাগজ–এ একটা লেখা লিখেছিলেন, শিরোনাম ছিল এই রকম, ‘মালিক থাকবেন নক্ষত্রের দূরত্বে।’

জনাব লতিফুর রহমান ছিলেন সেই রকম আদর্শ একজন সংবাদপত্র-উদ্যোক্তা। তিনি থাকতেন নক্ষত্রের দূরত্বে। নক্ষত্র কিন্তু দূরে থেকেই আমাদের পথ দেখায়। 

১৯৯৮ সালে প্রথম আলো বের হবে। আমরা অনেকেই সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে একজোট হয়ে যোগ দিয়েছি এই প্রকাশিতব্য কাগজে। আমরা তখন অফিস করতাম কারওয়ান বাজারে, বিএসইসি ভবনে। ওইখানে ট্রান্সকমের করপোরেট অফিস ছিল। আমার মনে আছে, প্রথম আলোর পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। দেশে তখন রঙিন দৈনিক বের হয় না বললেই চলে। প্রথমে ভাবা হলো রোজ রঙিন কাগজ বের করা হবে, রোজ ১৬ পৃষ্ঠা কাগজ দেওয়া হবে। খরচের অঙ্ক দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সেই ধারণা থেকে আমরা সরে আসতে চাইলাম। সম্পাদক মতিউর রহমান প্রস্তাব দিলেন জনাব লতিফুর রহমানের কাছে, সপ্তাহে তিন দিন কাগজ রঙিন করা হবে, তিন দিন ফিচার পাতা দেওয়া হবে। লতিফুর রহমান সাহেব বললেন, ‘আপনারা দেশের এক নম্বর কাগজ বের করবেন। এটাকে এক নম্বর আসনে আসতে হবে। আপনাদের সাংবাদিকতার মান নিয়ে আমি চিন্তা করি না। এটা আপনারা ভালো পারবেন। কিন্তু তিন দিন রঙিন, তিন দিন ফিচার, এই রকম করে ভাবছেন কেন! রোজ রঙিন, রোজ ফিচার পাতা, এইভাবে বড় করে পরিকল্পনা করেন।’ তিনি সব সময় প্রথম আলোকে বড় স্বপ্ন দেখতে, বড় পরিকল্পনা করতে, বড় কাজে হাত দিতে উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন। বিপুল বিনিয়োগের চাপ সামলাতেন। সম্পাদকীয় স্বাধীনতার প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম আস্থা এবং বিশ্বাস। মতি ভাই (মতিউর রহমান) বহুদিন বক্তৃতায় বলেছেন, তিনি, প্রথম আলোর সম্পাদক আর মাহ্ফুজ আনাম, ডেইলি স্টার সম্পাদক হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন সম্পাদক। আমরা যাঁরা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার–এর সঙ্গে জড়িত, তঁারা একবাক্যে এই কথাকে সমর্থন দেব, মালিকপক্ষ থেকে কোনো দিন সামান্যতম হস্তক্ষেপও করা হয়নি, কোনো দিন কাগজে কী ছাপা হবে বা হয়েছে, তা নিয়ে তারা কথা বলেননি। জনাব লতিফুর রহমান এবং ট্রান্সকম, সব সময়েই থেকেছেন নক্ষত্রের দূরত্বে। কিন্তু কর্মীদের এবং পত্রিকার ভালোর জন্য যে সমর্থন, সহযোগিতা, বরাদ্দ দরকার, তা সব সময়ই নিজের থেকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। 

জনাব লতিফুর রহমানসহ মিডিয়াস্টার লিমিটেডের পরিচালকেরা প্রথম আলোয় আসতেন বছরে একবার। ৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময়। সেই দিনটা ছিল আমাদের জন্য এক আনন্দের দিন। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম একটা বক্তৃতা দিতেন প্রথম আলোর প্রশংসা করে। আমরা খুব খুশি হতাম। আর আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম লতিফুর রহমান সাহেব কী বলেন তা শোনার জন্য। জনাব লতিফুর রহমান বলতেন, ‘সংবাদপত্রকে রোজ ভোটে যেতে হয়। পাঠক নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে পত্রিকা কেনেন। সেটা যদি তাঁর মনের মতো না হয়, তিনি এক দিন দেখবেন, দুই দিন দেখবেন, তৃতীয় দিন থেকে আর কাগজ রাখবেন না। আপনারা রোজ পাঠকের সামনে হাজির হন, পাঠক আপনাদের ওপর আস্থা রাখেন বলে পরের দিন, পরের মাসেও কাগজ কেনেন।’ তিনি বলতেন, ‘আপনাদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান আছে, পছন্দ–অপছন্দ আছে। সেটা আপনার নিজের কাছে থাকবে। যখন আপনি কাগজে লিখবেন, তখন আপনি নিরপেক্ষ। রিপোর্ট হতে হবে দলনিরপেক্ষ। কাগজকে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ এবং দলনিরপেক্ষ।’ তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতেন সততার কথা। প্রথম আলোর কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যেন অসততার কোনো অভিযোগ না ওঠে। 

লতিফুর রহমান নিজে ছিলেন সততার এক মূর্ত প্রতীক। তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ভ্যাট, শুল্ক, আয়কর মিলিয়ে সরকারের হাতে তুলে দেন বিপুল পরিমাণ টাকা, বছরের পর বছর নিজে থেকেছেন সর্বোচ্চ করদাতাদের শীর্ষ তালিকায়। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং পত্রিকা দুটো ছাপা হয় যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেই ট্রান্সক্রাফটও থাকে সর্বোচ্চ করদাতার তালিকায়। 

লতিফুর রহমান সব সময় বিশ্বাস করতেন সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতায়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায়। প্রথম আলোর স্বাধীন, দলনিরপেক্ষ অবস্থান কোনো সরকারই পছন্দ করেনি। পৃথিবীর কোথাও সরকারের সঙ্গে স্বাধীন সংবাদপত্রের সম্পর্ক মধুর হয় না, সম্পর্ক অম্লমধুরই হয়ে থাকে। বিএনপি জোট সরকার প্রথম আলোকে পছন্দ করেনি, বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল; আওয়ামী লীগ সরকার পছন্দ করেনি; এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারও পছন্দ করেনি। শুধু সরকার নয়, বাইরের নানা মহল থেকেও প্রথম আলোর ওপরে চাপ, আক্রমণ, হুমকি কম দেওয়া হয়নি। জনাব লতিফুর রহমান যদিও কোনো দিন জানতেও চাননি প্রথম আলোয় কী ছাপা হবে না হবে, ওই দায়িত্বটা সম্পাদকের হাতে দিয়ে তিনি থাকতেন নক্ষত্রের দূরত্বে, কিন্তু ঝড়ঝাপটা সবচেয়ে বেশি পড়ত গিয়ে বড় গাছটার ওপরে। জনাব লতিফুর রহমানকে নিয়ে পোস্টারও পড়ল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলো। সেই খবরও প্রথম আলোয় ছাপা হলো। তিনি নিজেই তদন্তের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানালেন। যারা এসব তদারক করছিল, তারা দুটো অডিট প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে দুর্নীতি খুঁজে বের করতে। অডিট প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রান্সকম গ্রুপের দশ বছরের কাগজ, বিশ বছরের কাগজ নিরীক্ষা করল। কোনো দুর্নীতিই তারা খুঁজে পেল না। বিদায়ের আগে আগে সেই সরকার জনাব লতিফুর রহমানের কাছে চিঠি পাঠাল, দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। 

এ রকম হয়েছে, প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের সম্পাদকীয় নীতি বদলাবেন না, আপনারা যা সত্য তা বলে যাবেন, হ্যাঁ, আপনারা কারও বিরুদ্ধেও জোর করে কিছু বলবেন না, আবার নরমও হবেন না, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে যান। কখনো লাভ হবে, কখনো লোকসান হবে, এটা তো মেনে নিতে হবেই।’ 

জনাব লতিফুর রহমান ২০১২ সালে অর্জন করেন ব্যবসা ক্ষেত্রে নোবেল বলে গণ্য অসলোর বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড। তিনি বলতেন, তাঁর নীতি হলো প্রথমে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ভালো থাকা নিশ্চিত করা। সেটাই তাঁর সিএসআর, করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি। আর কর্মীদের ভালো থাকা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাতে প্রতিষ্ঠানেরও ভালো নিশ্চিত করা যায়। সংবাদপত্র সম্পর্কে এই কথাটা আরও বেশিভাবে প্রযোজ্য। কারণ, সংবাদপত্র রোজ নতুন জিনিস নিয়ে হাজির হয়, এটা করেন কর্মীরা। কাজেই মানবসম্পদই হলো গণমাধ্যমের আসল সম্পদ। এখানে বিনিয়োগ করে যেতেই হবে। সে জন্য তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের কর্মীরা ভালো বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন। আমরা যে অনেকেই গাড়ি পেয়েছি, মোটরবাইক পেয়েছি, এর পেছনে ছিল তাঁরই উৎসাহ। 

ব্যক্তিগতভাবে তিনি আর তাঁর পরিবার সৌজন্যের প্রতিমূর্তি। আমরা কেউ কোনো দিন তাঁকে আগে সালাম দিতে পারিনি। আমাদের অফিস সহকারীরাও তাঁকে আগে সালাম দিতে পারেননি, তিনি আগে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেন। 

জনাব লতিফুর রহমানের ওপর দিয়ে শোকের ঝড় বয়ে গেছে অনেক বড় বড়। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ কন্যাকে হারিয়েছেন। সবচেয়ে প্রিয় নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন মারা গেছেন হোলি আর্টিজানের আক্রমণের সময়। লতিফুর রহমান সাহেব ওই দিন বিদেশে ছিলেন। খবর পেয়ে ঢাকা ফিরলেন। মতি ভাইয়ের সঙ্গে রোজিনা ইসলাম আর আমি রাত ১২টায় গুলশানে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তাঁরা আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘আসুন, ডাইনিং টেবিলে বসুন।’ আমাদের সোজা নিয়ে গেলেন খাবার টেবিলে। আলো জ্বেলে আবার খাবার দেওয়া হলো। আমার মনে আছে, তিনি আমার প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিলেন। আমরা তো সেই মর্মান্তিক প্রসঙ্গে তুলতে পারছিলাম না। তিনি ছিলেন ইতিবাচক মানুষ। বললেন, ‘ফারাজকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। ওর বন্ধুদের ছেড়ে সে আসতে চায়নি। আমি ভাবি, আমি তো এই সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারতাম না!’

ওই শোকস্তব্ধ রাতেও তিনি নিজে গেটের বাইরে এসে আমাদের বিদায় দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন। 

তাঁর প্রিয়তম দৌহিত্র ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীর তারিখে, পয়লা জুলাই, তিনি চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। ফারাজের বিদায়ের পরেই আসলে তিনি দুর্বল হতে শুরু করেছিলেন। 

তিনি বলতেন, ‘আমাদের পুরো পরিবারের একটাই পাসপোর্ট। বাংলাদেশের পাসপোর্ট। আমরা কোনো দিনও দেশ ছেড়ে যাব না।’ তাঁর মৃত্যুর পর শোকবার্তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্মরণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সময়ে তাঁর এবং ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তার কথা। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাঁর হৃদয়ে একটা বিশেষ জায়গা ছিল। তিনি সব সময়ই চাইতেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, শাস্তি হোক। তিনি কখনো পাকিস্তানে যাননি, এটা ছিল সচেতন সিদ্ধান্ত। 

বাংলাদেশের উন্নতিতে, বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন পরম আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশ কোন কোন ক্ষেত্রে ভারত আর পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছে, এই তথ্য-উপাত্তগুলো বলতে তিনি ভালোবাসতেন, তাঁর চোখ বাংলাদেশের সাফল্যের খবর পরিবেশনের সময় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। 

তিনি বাংলাদেশের বিজয়ের জন্য উদ্যোগী এবং তৃষ্ণার্ত ছিলেন। তিনি জানতেন, একটা দেশের ভালো থাকার জন্য গণতন্ত্র খুবই মূল্যবান আর গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন সাংবাদিকতা একটা অপরিহার্য উপাদান। সেটা জানা আর বাস্তবে মালিক হয়ে চাপ সহ্য করে সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার নীতি অব্যাহতভাবে বজায় রাখা এক নয়। তিনি একজন আদর্শ সংবাদপত্র-উদ্যোক্তা। তাঁর মতো দ্বিতীয় আর কাউকে এই দেশ পাবে কি? 

তিনি আমাদের ভালো রাখতে চেয়েছিলেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে ভালো রাখুন। 

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক