ইউরোপের আপনা প্রাণ বাঁচা মুহূর্ত

এএফপি ফাইল ছবি।
এএফপি ফাইল ছবি।

যখন কোভিড-১৯ ইউরোপে আঘাত হানল এবং কোটি মানুষকে অভ্যন্তরীণ নির্বাসনের দিকে ঠেলে দিল, অনেকেই তখন গভীর নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত হলো। এটা কেবল বন্ধু ও পরিজনের সঙ্গে আবার মিলিত হওয়ার জন্য আকুতির মধ্যেই প্রকাশিত হলো না, আরও বড় আকারে তারা জানল বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে তাদের দেশ ছিল অসহায় এবং পরিত্যক্ত। এই পরিত্যক্ত হওয়ার বোধ ব্যক্তির মানসিকতা এবং ইউরোপের নাগরিক বিশ্বদৃষ্টির ওপরও স্পষ্ট ছাপ ফেলল। 

সম্প্রতি ইউরোপীয় নয়টি দেশের ১১ হাজার নাগরিকের মধ্যে জরিপের মূল বার্তা ছিল এটাই। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স যে দেশগুলোতে জরিপটি চালায় সেগুলো হলো বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন ও সুইডেন। ইউরোপের দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের বাস এ দেশগুলোতে। এ জরিপ এটাও দেখায় যে দুর্যোগের গোড়ার দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সহায়তার অভাব সবার মধ্যে ইইউর সম্মিলিত কর্মসূচির দাবি আরও জোরালো করেছে। দেশগুলোকে সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করাই শুধু নয়, অতিমারি যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং করছে, তার মধ্যে টিকে থাকার জন্য সবাইকে উপযুক্ত করে তোলার দাবিও উঠেছে।

এই জরিপ দেখিয়েছে যে সংকটের সময় ইইউর প্রতিষ্ঠানগুলো, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান এবং ইউরোপের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা জনসাধারণকে নিঃসহায় করে দিয়েছে। ইতালির উত্তরদাতাদের ৬৩ শতাংশ এবং ফ্রান্সের ৬১ শতাংশ মনে করেছে যে অতিমারির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইইউ দাঁড়াতে পারেনি। এ ছাড়া খুব কমসংখ্যক মানুষই এখন মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের নিবিড় মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এই বীতশ্রদ্ধা কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অপছন্দ করায় শেষ হয়নি। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নৈরাজ্যিক দশা দেখে অনেক ইউরোপীয়ই ভাবছে, যে দেশটি নিজেকেই রক্ষা করতে পারছে না, সে কীভাবে পাশ্চাত্যের রক্ষাকারী হবে। একই সময়ে উত্তরদাতাদের বেশির ভাগই চীনের প্রতি শীতল মনোভাব দেখিয়েছে, অনেকে দেশটিকে করোনাভাইরাসের অতিমারির জন্য দায়ীও করেছে। 

অতিমারির আগে, ইউরোপীয় রাজনীতি মোটা দাগে জাতিবাদী ও বিশ্বায়নবাদী শিবিরে বিভক্ত ছিল। কিন্তু ভাইরাস এসে উভয় শিবিরের মধ্যে পার্থক্য প্রায় ঘুচিয়ে দিয়েছে। অনেক জাতীয়তাবাদী এখন উপলব্ধি করছে যে সংকটের কালে কোনো দেশ একা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। ওদিকে বিশ্বায়নবাদীরাও বুঝছেন যে যত দিন ট্রাম্প, পুতিন ও সি চিন পিং ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন সত্যিকার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। 

পরিণামে, উভয় গোষ্ঠীই ক্রমে আরও বেশি করে ইউরোপের জন্য নীতিভিত্তিক কান্টিয়ান কল্পরাষ্ট্রের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। ইউরোপজুড়েই মানুষ বুঝতে পারছে, চীন-আমেরিকা বাণিজ্য ও প্রযুক্তিযুদ্ধ বিশ্বায়নে গোলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন ইউরোপীয় পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা দেখতে চায়—আশা করা যায় এটা তাদের অর্থনীতি ও মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হবে। কেবল সবুজ অর্থনীতি কত ভালো, তা প্রচার করে গেলেই হবে না, ইউরোপ পারে কার্বনের মূল্য ঠিক করে দিতে এবং বিস্তৃত কর-সংগতির দিকে অন্যদেরও নিয়ে আসতে। হয় তারা ইউরোপের মানের সঙ্গে মানিয়ে নেবে, নয়তো কার্বন নিঃসরণের ক্ষতিপূরণ (খরচ) দেবে। 

ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয় সরকারগুলো এবং ব্রাসেলসভিত্তিক ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারছে, সংকট আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় পদক্ষেপের দরজা খুলে দিচ্ছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই বুঝতে হবে, ইউরোপজুড়ে ভোটারদের আরও বেশি সহযোগিতার দাবি মানে প্রতিষ্ঠান-গঠনের আকাঙ্ক্ষাই কেবল নয়, বরং এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপর্যস্ত দুনিয়ার ওপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়ার ভয়। 

ইউরোপ এখন অপরিহার্য কমিউনিটি, পছন্দ-অপছন্দের কিছু নয়। এবং ভোটাররাও আগের চেয়ে বেশি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেখছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব আলগা করার ঐক্য হিসেবে নয়, বরং তাকে শক্তিশালী করার হাতিয়ার হিসেবে। গত মে মাসে ফরাসি-জার্মান পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা হাজির করা হয়। সম্ভবত ইউরোপীয় গল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে যাচ্ছে এটি। কিন্তু আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের জন্য নেতাদের এমন যুক্তিকাঠামো ভাবা দরকার, যা ভোটারদের দূরে ঠেলার বদলে আরও বিজড়িত করবে। 

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে অনুবাদ

মার্ক লিওনার্দ ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের পরিচালক