করোনা-সংকটে মধ্যবিত্তের চাইবারও কেউ নেই

মেসেঞ্জারে আসা একটা পোস্ট দেখে চমকে গেলাম। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। কথাগুলো ভাঙা ভাঙা। অস্থির। চঞ্চল। বিক্ষিপ্ত। একটা সাহায্যের আবেদন। সঙ্গে একটা অনুরোধ, কথাগুলো যাতে পাবলিক না করি। কয়েকবার মেসেজটা পড়ি। মেসেজ পড়ে মনে হলো, ওপাশের মানুষটার বয়স ২৭-৩০ বছর। মনে হলো একজন আবেগপ্রবণ বাবা। কী ভেবে যেন একটা স্ক্রিন শট নিই ও কিছু আপন বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি। তাদের সবার বক্তব্য, এ পরিস্থিতির কথা তারাও শুনেছে এবং শুনছে। আমি অবাক হচ্ছি দেখে তারা অবাক। আমার চিন্তায় ভাটা পড়ে ফোন কলে। কলগুলো শেষে মেসেজটা খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই।

মেসেজটা এসেছিল আমাদের প্রসার কার্যক্রমের ফেসবুক পেজে। সেখানে নেই। পেজের কোনো অ্যাডমিন মুছে দিল কি না, ভাবতে ভাবতে স্ক্রিন শটটা আরেকবার দেখি। ফোন নম্বর আছে। কল দিই। কেউ ধরল না। কিছুক্ষণ পর একই নম্বর থেকে ফোন এল। কথা বললাম। পরিচিত হলাম। উনি বললেন, মেসেজটা মুছে দিয়েছেন কারণ তাঁর কাছে মনে হয়েছে পাবলিক কোনো পেজে অচেনা কারও কাছে এটা দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি বললাম, যদি পারেন আমাকে একটা মেইল করেন। ওনার বক্তব্যটা আমার কাজের জন্য জরুরি। উনি মেইল করলেন। সেই থেকে ভাবছি কী করব। দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার কাজ। আমি গ্রামীণ দারিদ্র্য ও এর কাঠামোগত আচরণ ও সমস্যাগুলো বুঝি। নগর দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করেছি অনেক—কিন্তু সেসব কাজ শ্রমিকদের নিয়ে। বস্তিবাসীদের নিয়ে। মধ্যবিত্তের দারিদ্র্য নিয়ে কখনো ভাবিনি। কাজ করার সুযোগ হয়নি। আমি তাই থতমত খেয়ে যাই। উপায় খুঁজতে থাকি।

করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই মনে হলো, একটা নতুন, অচেনা এবং কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। চিন্তিত ছিলাম মধ্যবিত্তের ওপর যে অর্থনৈতিক সংকট আসছে সেটা কে সামলাবে এই ভেবে। আমি চিন্তিত ছিলাম, কারণ আমরা দারিদ্র্যকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যবিত্তের সংকট আমরা বুঝতে পারব না ভেবে। হয়েছেও তা-ই। আমাদের কোনো গবেষণায় মধ্যবিত্ত নেই। যারা দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছিল কিন্তু আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে, আমরা তাদের মাথা গুনেই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে; সেখানে মধ্যবিত্ত চিহ্নিত হবে কীভাবে?

আমার কাছে আবেদন নিয়ে আসা মানুষটার কথাই ভাবুন। উনি বলছেন, আমি যাতে তাঁর মেসেজটা পাবলিক না করি। উনি একবার লিখে আবার মুছে দিয়েছেন। আমরা দরিদ্রদের চিহ্নিত করছি। সেখানে নতুন-পুরোনো সব শ্রেণির দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত নেই। মধ্যবিত্ত দারিদ্র্যের খাতায় নাম দেবে না। মধ্যবিত্ত লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন নেবে না। সরকারি ট্রাক থেকে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্য কিনবে না। হয়তো বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইবে। হয়তো বাচ্চার স্কুল বন্ধ রাখবে। হয়তো চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে—যদি বাড়িতে কোনো ঠিকানা আদৌ থেকে থাকে। মধ্যবিত্ত কি ক্ষুদ্র ঋণ নেবে? সে ঋণ নিয়ে কী করবে? তাঁর মাথায় তো এমনিতেই ঋণের বোঝা।

মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে একটি লেখা কয়েক দিন আগে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আমাদের যখন-তখন বাইরে ঘুরতে যাওয়া, দামি রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া, দামি প্রসাধনের ও পোশাকের শখ, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার শখকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে সেই লেখায়। এ যুক্তির সমস্যা হলো, এটা মানতে গেলে ফানুসের মতো শহরের তারাগুলো নিভে যাবে। পায়ের তলার খুঁটি সরে যাবে। তারাঝলমলে রেস্তোরাঁ নেই। ২৫ বছরের প্রাণচঞ্চল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার তরুণী নেই। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে আসা পাঠাওয়ের রাইডার নেই। রাইডারের বাইক নেই। রাইডার যে দোকানে বসে খান, সে দোকানের রুস্তম নেই। রুস্তমের দোকানের মালিক নেই। মালিকের বাচ্চার টিউটর নেই। ঠিক এখানেই শুরু হয় সাহায্যের আবেদন পাঠিয়ে আমাকে লেখা অসহায় বাবার সংকট।

এ সংকটের ভয়াবহতাটা হলো এটা খুব শিগগির যাবে না। এখানে একজন কে ফেলে আরেকজন এগোতে পারবে না। সোশ্যাল সেইফটি নেট শুধু শ্রমিক আর অতিদরিদ্রকে কয়েক মুহূর্তের দম দেবে। তাও যদি তাদের হাতে টাকা পৌঁছায়। কিন্তু এখানে মধ্যবিত্ত কোথায়? তাঁর দায়িত্ব নেবে কে? তাকে ক্রমেই গভীর হতে থাকা অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে নিয়ে আসবে কে? যদি মধ্যবিত্তের ভিত্তি সরে যায়, তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি উঠে দাঁড়াবে কীভাবে?

আমাদের নগর দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করতে হবে এখনই। সেটা করতে গেলে মধ্যবিত্ত কে কিংবা তাকে কীভাবে চিহ্নিত করা হবে, সেটার ব্যাপারে একটা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত জরুরি। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত—এ তিন শ্রেণিকে আমরা কিসের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করব, তার একটা বাস্তবিক রূপরেখা দরকার। মধ্যবিত্তকে কি আয়ের ধারায় সংজ্ঞায়িত করা হবে, নাকি ব্যয়ের ধারায়? গ্রামীণ দারিদ্র্য বুঝতে আমরা মাথাপিছু আয়, নিজস্ব জমির পরিমাণ, খাদ্যের পেছনে খরচ—এ ধরনের কিছু পরিমাপ ব্যবহার করি। এর আঙ্গিকে নগর দারিদ্র্য বুঝতে গিয়ে যদি আমরা ইনফরমাল সেক্টরে জড়িত শ্রেণিকেই বেছে নিই, তাহলে মধ্যবিত্তের সংকট চাপা পড়ে যাবে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ তরুণ ও অবিবাহিত। এদের একটা অংশ পরিবারের সঙ্গে থাকে, আবার একটা অংশ থাকে এককভাবে। মধ্যবিত্তের একই আয় শ্রেণির মধ্যেই একটা অংশ থাকে নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে আর একটা অংশ থাকে ভাড়া বাসায়। একটা বৃহৎ অংশ ভূমিহীন। এ বিভাজিত জনগোষ্ঠীর করোনা সংকট বুঝতে হলে খুব সম্ভবত আয়ের উৎস (স্থায়ী ও অস্থায়ী) ও মাথাপিছু সর্বনিম্ন দৈনিক খরচের একটা পরিমাপ তৈরি করে নিতে হবে প্রথমেই। এ পরিমাপে দৈনিক খাবার খরচ, আপ্যায়ন খরচ, ইন্টারনেট খরচ, মোবাইল ফোনের টকটাইমের খরচ, যাতায়াত খরচ, বাসস্থানের খরচের হিসাব থাকা জরুরি। এ মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে আমরা খুব দ্রুত মধ্যবিত্তের সংকটটাকে একটা ছকে নিয়ে এসে করোনা পরিস্থিতিতে এর অর্থনৈতিক বিন্যাস, ব্যাপ্তির একটা পরিকল্পিত পর্যালোচনা শুরু করতে পারব।

করোনা পরিস্থিতে আমরা সব বিষয়েই দেরিতে, অপর্যাপ্তভাবে ও অপ্রস্তুত অবস্থায় কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে আলোচনাটাও একটু দেরিতেই শুরু হলো। অন্তত পর্যালোচনা ও ব্যবস্থাপনাটুকু যাতে সঠিকভাবে হয়, সেটাই কামনা।

মো. রুবাইয়াৎ সারওয়ার: উন্নায়ন গবেষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনোভেশন কনসালটিং।