ছোট নৌকায় বড় দুর্ঘটনা

অনেক বছর আগে, পাকিস্তান আমলে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালাম ‘জাহাজঘাটের কুলি’ নামে এক অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন। এই গল্পের নায়ক এক কুলি ঘাটে ডুবে যাওয়া একটি শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা সদরঘাট কিংবা অন্যান্য স্থানে যেসব নৌযাত্রী দুর্ঘটনায় পড়েন, তঁাদের বেশির ভাগই জীবিত কূলে ফিরে আসতে পারেন না। ফিরে আসেন লাশ হয়ে।

গত শনিবারের প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে ঢাকার সদরঘাট থানায় ২০১৯ সালে ঘাটে নৌ-দুর্ঘটনায় ২৩ জন এবং ২০১৮ সালে ১৩ জনের মৃত্যু ঘটে। আর চলতি বছরের ছয় মাসে মারা গেছেন ৩৭ জন, যাঁদের মধ্যে ৩৪ জনই ছিলেন গত সোমবার ডুবে যাওয়া লঞ্চ মর্নিং বার্ডের যাত্রী। ময়ূর-২ নামের একটি বড় লঞ্চ পেছন থেকে ধাক্কা দিলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সব দুর্ঘটনার কথা বিআইডব্লিউটিএর খাতায় লেখা থাকে না। বিশেষ করে রাতের বেলা লঞ্চ, বালুবাহী ট্রলার ও জাহাজের ধাক্কায় ছোট ছোট নৌকা ডুবে বা দুর্ঘটনায় যঁারা মারা যান, যঁাদের লাশ দু–চার দিন পর ভেসে ওঠে—তঁারা থাকেন হিসাবের বাইরে। কী কারণে তঁারা লাশ হলেন, সেটি কখনোই জানানো হয় না।

ঢাকার সদরঘাট বা এ অঞ্চলে নৌ–দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বুড়িগঙ্গায় নৌযানের বিশৃঙ্খল অবস্থান, বেপরোয়া চলাচল, নৌপথ সরু হয়ে যাওয়া, ছোট নৌকায় মানুষের পারাপার, নৌ–পুলিশের গাফিলতি এবং কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যকেই দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সদরঘাটে নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই ছোট নৌকার যাত্রী। লঞ্চ, ট্রলার, বালুবাহী জাহাজের ধাক্কায় ছোট নৌকার যাত্রীরা হতাহত হন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, সদরঘাটকেন্দ্রিক নৌ-দুর্ঘটনার বড় কারণ নৌকার মাঝিদের অসতর্কতা। বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জ। স্থানীয় লোকজন নদী পারাপার হন ছোট ছোট নৌকায়। বাবুবাজার থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত দুই তীরে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ নৌকা এভাবে চলাচল করে। এ ছাড়া সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের উল্টো দিকে ডকইয়ার্ড থাকায় সেখানে বহু লঞ্চ অলস দাঁড়িয়ে থাকে। এতে নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হয়, যা অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন হচ্ছে সদরঘাটে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে? এ জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে? বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক এক সপ্তাহের মধ্যে লঞ্চঘাটে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। খেয়াঘাট সরানো, লঞ্চঘাট সম্প্রসারণ ও পন্টুনের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

বিআইডব্লিউটিএ প্রধান যা বললেন, তার সবটাই ভবিষ্যৎ পদবাচ্যে। অর্থাৎ করা হবে, করতে হবে। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি শুনতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এসব প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে, সেগুলো দূর করাই হচ্ছে আসল কথা। একই সঙ্গে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। নৌ–পুলিশ ও নৌযান মালিক সমিতিসহ বিআইডব্লিউটিএর কাজের সঙ্গে যেসব সংস্থা জড়িত, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার কাজটি করতে হবে। তা নিশ্চিত করতে না পারলে নৌযাত্রীদের মৃত্যুর দায় বিআইডব্লিউটিএ ও সর্বোপরি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। অন্য কাউকে দায়ী করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

সদরঘাট এলাকায় ছোট নৌযান চলাচল বন্ধ করার উদ্যোগ অতীতে একাধিকবার নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, কোনটি কীভাবে বাস্তবায়নযোগ্য, সেটাও বিবেচনায় থাকতে হবে। দুই পারের মানুষের পারাপারের বিকল্প কী হবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হলে তা টেকসই হবে।