মঙ্গল কাম্য, অশুভর জন্য প্রস্তুত থাকা ভালো

জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকা সত্ত্বেও গত দশ-বারো বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে গিয়েছিল। সে জন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। সেই সময় কোভিড–১৯ মহামারি এল আকস্মিক ও একেবারেই অপ্রত্যাশিত আঘাত হয়ে। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এত বড় বিপদ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো দেশেরই ছিল না। ফলে গোটা পৃথিবীতে গত কয়েক মাসে মারা গেছেন মোট ৫ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ, আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ১২ লাখের বেশি। জীবন ও জীবিকা বিপন্ন শত শত কোটি মানুষের।

বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স স্বাভাবিক রয়েছে, কমেনি; যা স্বস্তির কথা। ১ কোটি ২০ থেকে ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আছেন। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশও যদি চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় সমস্যার কারণ হবে। দেশের নতুন কর্মহীনদের সঙ্গে তাঁরা যোগ হলে গুরুতর সংকট দেখা দেবে।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় একমুঠো ভাতের আশায় গ্রাম থেকে মানুষ শহরে ছুটে গিয়েও বাঁচতে পারেনি। হাড্ডিসার মানুষের মরদেহ পড়ে থাকত রাস্তায় রাস্তায়। সে দৃশ্যের কিছু ছবি পাওয়া যায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্মে। ঠিক তার বিপরীত দৃশ্য দেখছি কয়েক দিন ধরে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট এবং রেলস্টেশনে পোঁটলা-পুঁটলিসমেত মানুষের ভিড়। শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে মানুষ, যে গ্রাম থেকে একদিন খেয়ে-পরে বাঁচার আশায় এসেছিল শহরে। শত কষ্টের মধ্যেও বেঁচেবর্তে ছিল। যারা যাচ্ছে গ্রামে ফিরে, তারা সবাই যে হতদরিদ্র তা নয়। বরং নিম্নমধ্যবিত্তই বেশি। তাদের গ্রামে ফেরার দৃশ্য দেখে মনে পড়ছে শাপমোচন ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বেকার উত্তমকুমারের গাওয়া গান, ‘শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা। ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা।’ ওই গানেরই অনুকরণে ঢাকার ছবি নীল আকাশের নিচের গানটি লিখেছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়/ দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়।’

এখন যারা বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ও ঢাকা ছাড়ছে, তাদের সঙ্গে একাত্তরের ২৭-২৮ মার্চে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের যাত্রার আমি মিল দেখতে পাচ্ছি। সেদিন মানুষ পালাচ্ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে। এখন পালাচ্ছে করোনার ভয়ে নয়; না খেয়ে মরার ভয়ে। আশ্রয়হীন হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। রোজগার নেই বলে বাড়িভাড়া পরিশোধের সামর্থ্য নেই। বাড়িওয়ালা থাকতে দিচ্ছে না। বাড়িওয়ালার দোষ নেই, তার সংসার চলবে কীভাবে?

একাত্তরে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে যাত্রার সঙ্গে আজকের মানুষের যাত্রার তফাত হলো এই যে ৯ মাস পরে তারা আবার ফিরে আসতে পেরেছিল। এবার যে কবে ফিরবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এবারের যাত্রা অনিশ্চিত। অবশ্যই অনেকে ফিরবে, তবে তা ৯ মাসের আগেও হতে পারে, আবার ১৯ মাসেও না হতে পারে। সে জন্যই দেখছি, অনেকেই ঢাকা ছাড়ছে, তাদের কোলে বাচ্চা, হাতে হাঁড়ি-পাতিল-বদনা।

জাতীয় অর্থনীতি বড় হয়েছে। কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। গ্রামের কর্মহীন মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরে ও শিল্পাঞ্চলে ছুটে এসেছে। তা সত্ত্বেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতই বড়। সেটা শহরেও, গ্রামেও। হাজার বছর গ্রামীণ অর্থনীতিই ছিল বাঙালির জাতীয় অর্থনীতি। গ্রামে উৎপাদিত দ্রব্যই বাংলা থেকে মধ্যযুগে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস এবং প্রাচীন বাংলার দৈনন্দিন জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই, বাঙালির গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল প্রাণবন্ত ও টেকসই। সে জিনিসটি আমরা হারিয়েছি গত ১০০ বছরে।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিচে রাষ্ট্রের যে কয়টি প্রশাসনিক ইউনিট রয়েছে যেমন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন; তার মধ্যে ইউনিয়নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। ব্রিটিশ আমলেও তাই ছিল। ওপরে ছিল জেলা বোর্ড। এখন ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদের সঙ্গে যোগ হয়েছে উপজেলা পরিষদ। এতগুলো স্তর থাকায় কাজের সমন্বয় করা অনেক সময় কঠিন হয়।

দেশে ইউনিয়নের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭১টি। সেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন লাখখানেক। তাঁদের ১০টি বাধ্যতামূলক কাজ এবং ৩৮টি ঐচ্ছিক কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় তাঁদের মাথার ওপরে প্রভুর সংখ্যা বহু। এমপি, জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন এবং থানা-পুলিশ। সরকারি দল ও ‘তাদের’ অঙ্গসংগঠনের নেতা-উপনেতারা তো রয়েছেনই। তাঁদের গম ও ত্রাণ চুরির কথা বড় করে প্রচার করা হয়, যদিও সবাই অসাধু নন।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বড় যোগ্যতা, তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের এলাকার সব মানুষকে চেনেন। এবং চেনেন বলে যদি তাঁরা চান তাহলে এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রশাসনের কাজ হবে নজরদারি করা, মাতবরি করা নয়।

জীবিকা হারিয়ে শহর থেকে যাঁরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁদের প্রায় কারও বিশেষ সম্পদ নেই। তাঁদের ত্রাণনির্ভর করা সমস্যার সমাধান নয়। সে সংগতি রাষ্ট্রের নেইও। তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে জন্য সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজটা লোকাল গভর্নমেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পালন করতে দেওয়া উচিত।

বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের যে ধরন, সেই প্রথাগত ধারায় করোনা-পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। একই উপায়ে সব এলাকার মানুষের বেকারত্বের সমস্যা সমাধানও করা যাবে না। কোথাও কৃষি, পশুপালন প্রভৃতির ওপর জোর দিতে হবে, কোথাও কুটিরশিল্প বা অন্য কিছু প্রতিটি এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতির ধরন ভিন্ন।

একাত্তরে ছিন্নমূল মানুষ সব দুঃখ-দুর্দশা মেনে নিয়েছিল একটি বড় প্রাপ্তির আশা থেকে। মানুষ জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। আজ অবস্থা তেমনটি নয়। মানুষ মোটের ওপর একটা স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছিল। তাতে বাধা আসায় সে বিভ্রান্ত। তাদের হতাশাগ্রস্ত না হতে দিয়ে আশাবাদী করে তোলাই রাষ্ট্রের আশুকর্তব্য। হতাশাগ্রস্ত মানুষেরাই সমাজে অনাচার ঘটায়।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে চলছে অস্থিরতা। এর মধ্যে শহর থেকে মানুষ যদি গ্রামে গিয়ে সেখানকার শান্তি নষ্ট করে, তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে জাতীয় জীবনে।

করোনার মধ্যেই ধেয়ে এসেছে বন্যা। বন্যা-ঘূর্ণিঝড় আমাদের সাংবৎসরিক বিপদ। তা নিয়েই আমাদের মানুষ বাস করতে অভ্যস্ত। করোনার মতো মহামারিতে অভ্যস্ত নয়। আমরা সব সময় মঙ্গল চাইব, কিন্তু সম্ভাব্য অশুভ অবস্থা মোকাবিলার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক