মহামারির পরে কেমন হবে জীবন

প্রতীকী ছবি। রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। রয়টার্স

কোভিড মহামারির তাণ্ডব আরও কত দিন চলবে, তা অনুমান করা যাচ্ছে না। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে দ্বিতীয় ঢেউ আসবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। লাতিন আমেরিকায় জেঁকে বসেছে, আফ্রিকায়ও হানা পড়েছে, অপেক্ষা শুধু পুরোদমে ছড়িয়ে পড়ার। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রকোপ অব্যাহত আছে, বাংলাদেশে বাড়ছে। এর মধ্যে অর্থনীতির অচল চাকা সচল করতে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, কোভিড–উত্তর পরিস্থিতিতে আমরা কি চিরাচরিত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাব? পরিচ্ছন্নতা বোধ ও চর্চার অভাব, অপরিমিত খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার–অনুষ্ঠানে আড়ম্বর প্রদর্শন, কেনাকাটায় মিতব্যয়িতা ও শৃঙ্খলার অভাব—এসব কি আগের মতোই থাকবে? ভবিষ্যতের প্রজন্মকে আমরা কীভাবে গড়ে তুলব? কোনো কঠিন পরিস্থিতি আমাদের যত বড় ধাক্কাই দিক, যেহেতু আচার–আচরণ ও সংস্কৃতির কাঠামো তৈরি হয় সুদীর্ঘ সময় ধরে, সেহেতু প্রশ্ন জাগে: আমরা কি করোনাকালের আচরণ সাময়িক ও আপদকালীন বলে ধরে নেব, এবং এই দুঃসময় পেরিয়ে গেলে আবারও সেই সব পুরোনো অভ্যাসেই ফিরে যাব? এই কঠিন দুঃসময় কি আমাদের জন্য কোনো শিক্ষা রেখে যাবে না?

ব্যক্তিক বা সামাজিক আচরণের বিষয়ে এই প্রশ্ন থাকছে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে কোভিড মহামারি চলে যাওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতিকে এর জের টানতে হবে। জাতীয় অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি আগের চেয়ে নিম্নমুখী হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতির এমন দুরবস্থা কেউ দেখেনি। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাব্য পরিবর্তনের আরও অনেক ইঙ্গিত স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান।

করোনাকালে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ যে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। উন্নত–অনুন্নত অনেক দেশে উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়া এবং অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি লেনদেন থেকে পাওনা আদায় আটকে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ক্ষতি, চাকরি হারানো মানুষদের জীবিকা সহায়তা এবং লোকসানে পড়া অজস্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য অর্থ প্রদানের চাপ, দিশেহারা পরিস্থিতিতে সবার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষা, একে অপরকে দোষারোপের রাজনীতিতে মেতে ওঠা ইত্যাদি কারণে করোনা-পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকট প্রকট হবে। কিছু বিশেষজ্ঞ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলেও সতর্ক করছেন। বলা হচ্ছে, করোনা–পরবর্তী কয়েক বছর উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে। অনেক দেশের জন্য অভ্যন্তরীণ বেকারত্বের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে কর্ম হারানো একটি বড় সমস্যা আকারে আবির্ভূত হতে পারে। বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি যুক্ত হয়ে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

করোনা–পরবর্তী সময়ে ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলো অভিবাসী গ্রহণে অপারগ হবে। মধ্যপ্রাচ্যেও অভিবাসী কর্মীদের চাহিদা বাড়বে এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই করোনার কাল শেষ হলে লোকেরা যদি নিশ্চিত জীবনের আশায় দেশান্তরি হতে অভিবাসীর ঢল নামায়, তাহলে অনেক দেশেই স্থানীয় ও বিদেশিদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের বর্তমান ধারা পাল্টে যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা যেভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, তা ঠিক হতে সময় লাগবে। আমদানি–রপ্তানির ধরন আগের মতো থাকবে না। অনেক দেশই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ রাখা, এমনকি জরুরি অবস্থা চালু করবে। অনুমান করা যায় যে বিশ্বজুড়ে চলাচলে নতুন নতুন বিধিনিষেধ আসবে, অনেক দেশ ভিনদেশিদের প্রবেশ, বসবাস, চাকরি কিংবা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করবে।

করোনার কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে কী পরিমাণ ক্ষতির শিকার হবে, তার আর্থিক হিসাব তৈরি করা খুবই জটিল। তবে বেশ কিছু অনুমান ধরে প্রাক্কলন করা এক হিসাবে বলা হয়েছে যে ২০২০ সালের মে মাস শেষে (আগের ৩ মাসের) মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ।

মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এই চার মাস বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় কৃষি খাতে নানা কর্মকাণ্ড মোটামুটি চালু ছিল। তবে অর্থনীতির অধিকাংশ খাত বস্তুত স্থবির থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ, এমনকি মধ্য আয়েরও অনেকে দুর্দশায় পড়েছে। সরকারের বহুমুখী আর্থসামাজিক কার্যক্রম ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত উদ্যোগে অর্জিত সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে কোভিড মহামারি; মানুষকে নতুন করে দারিদ্র্যে নিপতিত করছে। সমস্যায় পড়েছে আমাদের শিল্প খাত, সেবা খাত (সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে যোগাযোগ, পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, অন্য বহুবিধ সেবা), বিদেশে কর্মসংস্থান, বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ। অর্থনীতির সব খাতই এখন পর্যুদস্ত।

বিশ্বের বহু দেশকেই করোনা মহামারির ক্ষত সারিয়ে তুলতে তাদের সম্পদের বড় অংশ ব্যয় করতে হবে বলে তারা নতুন বিনিয়োগে খুব একটা উদ্যোগী হতে পারবে না। তবে যেসব দেশ তেমন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, যেসব দেশের বেসরকারি খাতে ব্যবসায় সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করছে বা করতে সক্ষম, তাদের জন্য জৈব-প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবা খাত সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে নতুন প্রবণতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে অনলাইন স্কুলিং বা হোম স্কুলিং, অনলাইন অফিস বা ওয়ার্ক অ্যাট হোম, অনলাইন ব্যাংকিং এবং কেনাকাটা। এসবই হবে আসন্ন ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের’ মূল অনুষঙ্গ।

সমস্যা ও সম্ভাবনা মিলিয়ে পরিস্থিতি যেমনই হোক, স্বল্প মেয়াদে আমাদের প্রধান লক্ষ্য করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া। এরই মধ্যে হিসাব করতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক ক্ষয়ক্ষতির, খুঁজতে হবে ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কার্যকর উপায় ও পদক্ষেপ।

ড. এস এম মাহফুজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য