ভোটার নয়, ইসি চাইছে সংবিধান টিকে থাক

সংবিধান বড়, না মানুষ। আমাদের নির্বাচন কমিশন বলছে, সংবিধান বড়। গত মার্চে করোনার শুরুতে, যখন সংক্রমণ ছিল নগণ্য, ঢাকা শহরবাসীকে তারা সংবিধান দেখিয়েছিল। তখনই ১৫ হাজার ভোটে খোদ রাজধানীতে একটি অর্থহীন উপনির্বাচন আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। এখন তারা যশোর ও বগুড়ায় ঘোর করোনায় জোড়া উপনির্বাচন করতে যাচ্ছে। ১৪ জুলাই নির্বাচন হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১১ জুলাই হেলিকপ্টারে নিষ্ফল দর্শন দেবেন ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগে। নিষ্ফল শুধু তঁার সফরটিই হবে না। পুরো অনুশীলনটাই একটি পণ্ডশ্রম, অমানবিকও। এটা সবার জানা ও বোঝার কথা। কিন্তু ইসি অবুঝ। রাজশাহী বিভাগের মোট সাড়ে চার হাজার আক্রান্তের সাড়ে তিন হাজারই বগুড়ায়।

 বগুড়া-১ আসনটি সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি নিয়ে গঠিত। বেশির ভাগ মানুষ চরের। করোনার পরে তাদের জীবনে আঘাত হেনেছে বন্যা। সারিয়াকান্দির পূর্বে যমুনা, পশ্চিমে বাঙ্গালী নদী। তাই ১০–১১টি ইউনিয়নের মধ্যে অধিকাংশ কমবেশি পানিতে ডুবে আছে। শুধু সারিয়াকান্দিতেই সাড়ে ১২ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। সোনাতলার ২০ গ্রাম প্লাবিত, পানিবন্দী সাড়ে তিন হাজার পরিবার। সারিয়াকান্দির আরও ৩ হাজার পরিবার বাঁধে, খোলা আকাশের নিচে, ১৫ দিন ধরে। অন্তত ২০টি চর ঘুরে দেখা আমাদের প্রতিবেদক বললেন, কারও টেস্ট হয়নি, কেউ মাস্ক পরেনি। সিইসির উচিত ছিল এ রকম একটি চরে কী বাঁধে হেলিকপ্টার থেকে নেমে পড়া। মানুষের সঙ্গে কথা বলা। তারপর ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া। ঢাকা-১০ আসনের তিন লাখ ভোটারের ৫ শতাংশ করোনার শুরুতে ভোট দেন। তাহলে তীব্র করোনা ও বন্যার মধ্যে বগুড়া-১ আসনের তিন লাখ ভোটারের কত শতাংশের ভোট আশা করবে কিংবা দেখিয়ে স্বস্তি পাবে ইসি?

ঢাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তঁারা জোরালোভাবে সংবিধান দেখালেন। বললেন, আমাদের তো হাত-পা বাঁধা। ৯০ দিনের মধ্যে হওয়ার কথা। সংবিধান বলেছে, দৈব–দুর্বিপাকে আরও ৯০ দিন বাড়ানো যাবে। ইসি সেটা করেছে। ১৫ জুলাই ১৮০ দিন শেষ হবে। তো ইসির সামনে উপায় ছিল না।

আসল কথা হলো সংবিধান বাধা ছিল না। সংবিধানটাকে তারা অছিলা বানিয়েছে। শাসকশ্রেণি সংবিধানের অনুশাসন সাধারণত মানে না। তারা এটাকে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। বললাম, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদটা চোখে পড়ল না আপনাদের? কিছুদিন আগেই নির্বাচন কমিশনের কমিশনাররা মুখোমুখি সভা করেছেন। মাহবুব তালুকদার বাদে অন্যরা ছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু সেখানে তঁারা ১০৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেছেন বলে শুনিনি।

১০৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘যদি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে সেই সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপীল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।’

উপমহাদেশে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসেও এ অনুচ্ছেদের ব্যবহার বিভিন্ন সময়ে লক্ষ করা গেছে। বিচার বিভাগের একটি বড় ভূমিকা থাকে নির্বাচনে। করোনাকালে বিচার বিভাগ কেবলই জামিন এবং জরুরি বিষয়গুলো শুনছেন। সেই জরুরি বিষয়ের মধ্যে ভোট পড়ে না। কারণ ভোট খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো কোনো মৌলিক অধিকার নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়াদ আগস্টের গোড়ায় শেষ হবে। তফসিল ঘোষণার পরও করোনা বিবেচনায় সেখানে ভোট হচ্ছে না। ইসি এখানেও সংবিধান দেখাচ্ছে। বলছে, ওটা বাধ্যতামূলক নয়, তাই ভোট নেওয়ার কোনো চিন্তা নেই।

সুতরাং এটা পরিষ্কার যে শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে দুটি সংসদীয় উপনির্বাচনের শ্রাদ্ধ হতে যাচ্ছে। এই রকম সংবিধানের দোহাই দিয়ে আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে নানা মাত্রায় অপকর্ম ঘটেছে। অবৈধ জিনিসকে বৈধ করা হয়েছে। যশোর ও বগুড়ায় যেভাবে উপনির্বাচন করা হচ্ছে, তা শুধু করোনাকালের কারণেই নয়, অন্য কিছু বাস্তব কারণেও প্রশ্নবিদ্ধ।

সার্বিকভাবে বাংলাদেশের গোটা নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের ভক্তি–শ্রদ্ধা নিচে নেমে গেছে। এ জন্য কে দায়ী, সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা কঠিন। কিন্তু গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য যেটা ভাবার বিষয় সেটা হলো, এভাবে হেলাফেলায় নামকাওয়াস্তে নির্বাচন সেরে ফেলতে থাকলে তার সামাজিক অভিঘাতগুলো কী হবে?

আমাদের হাতে কোনো সমীক্ষা নেই, তাই তাই বলা কঠিন। কিন্তু একটি নজিরবিহীন অতিমারির মধ্যে মানুষ যে লকডাউন বিধি বা সরকারি নির্দেশগুলো মানল না, শতাধিক জনপ্রতিনিধি যেভাবে অপসারিত হলেন, প্রশাসনের অভ্যন্তরের দায়িত্বশীল মানুষগুলো যেভাবে দায়িত্বহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত হলেন, তার সঙ্গে ভোট বা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রুগ্‌ণ করে ফেলার কোথাও একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়। গণতন্ত্রের ঘাটতি ও আইনের শাসন থেকে পিছলে পড়া সমাজ ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে না। করোনার মতো একটি পুরো অরাজনৈতিক বিষয় আমরা সামলাতে পারিনি। এটা শুধু সম্পদের অভাবেই ঘটেছে তা নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক শাসনপ্রক্রিয়ায় আমজনতার স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণ হারিয়ে গেছে। প্রায় সর্বত্র তারই ছাপ আমরা দেখছি করোনাকালে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অসামর্থ্য ও অপারগতা উদ্বেগজনকভাবে তলানিতে ঠেকেছে। এ রকম একটি অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণ লাগবে। সব বিশেষজ্ঞই একমত হয়ে বলেছেন, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা লাগবে। কিন্তু কোথায় কমিউনিটি। এটা রাতারাতি গড়ে উঠবে না। কমিউনিটি বিভক্ত, হতাশ।

উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত বগুড়া-১–এর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নানের অবদান দলে বিরাট। তাই আপনা-আপনি তাঁর স্ত্রী টিকিট পেলেন। একই অবস্থা যশোরের কেশবপুর উপজেলায়। গোটা মূল শহর এবং একটি ইউনিয়ন রেড জোনে। এ নির্বাচনও উপদলীয় কোন্দলের ছায়ামুক্ত নয়। যশোর আওয়ামী লীগের মারকুটে ভাবমূর্তির সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন টিকিটপ্রত্যাশী ছিলেন যশোর সদরে। কেশবপুরের লোক না হলেও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকের মৃত্যু তঁার কপাল খুলে দিয়েছে। ইসমত আরার আমেরিকাপ্রবাসী স্থপতি কন্যা টিকিটপ্রত্যাশী ছিলেন। টিকিট না পেয়ে আমেরিকায় ফিরে গেছেন।

বলছিলাম, করোনায় কেন কমিউনিটি সম্পৃক্ততা নেই। এটা শুধু বিরোধী দলকে পর্যুদস্ত থাকার বিষয় নয়। ক্ষমতাসীন দলটি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় একদম বিমুখ। নিজকে সে ক্ষতবিক্ষত করছে। জন্ম দিয়ে চলছে সম্রাট, পাপিয়া এবং রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদের মতো চরিত্র। দলের সিংহভাগ যোগ্য লোক স্থানীয় নেতৃত্বে থাকলে করোনাকালের ব্যবস্থাপনা উন্নত হতোই। সারা দেশে নির্বাচিত লোক মানেই আওয়ামী লীগার। অথচ তারা নিজেদের লোকদেরই করোনা মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এই শূন্যতায় নব উত্থান প্রশাসন ক্যাডার নেতৃত্বের।

নির্বাচন কমিশনকে সামনে আরও সংসদীয় উপনির্বাচন করতে হবে। তারা তফসিল দেবে, ইভিএমে ভোট নেবে। ফল গেজেটে দেবে। আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে। বলবে, আমরা গণতন্ত্রের সুরক্ষা দিচ্ছি। বিএনপির বর্জন করা আসন্ন ভোটের উভয় স্থানে নৌকার প্রতিযোগী সেই এরশাদের লাঙ্গল। ‘আমরা আমরাই’!

প্রকৃত চিত্র কী। কেশবপুরের একটি গ্রাম মাগুরখালী। আমাদের সংবাদদাতা গিয়েছিলেন মানুষ কী ভাবছে, শুনতে। তখন মাইকিং হচ্ছিল। চায়ের দোকানের মানুষ হাসছিল। এটা ভোটের প্রতি আমজনতার হাসি নয়, এই হাসির পেছনে আছে হতাশা ও দীর্ঘশ্বাস।

মিজানুর রহমান খানপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক