করোনা ম্যাপিং করা ও তার প্রয়োগ কেন জরুরি

যেহেতু কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব না, কে আক্রান্ত এবং কে আক্রান্ত না। তাই ব্যাপক হারে পরীক্ষা না করার কোনো বিকল্প নেই। পর্যবেক্ষণ বলে, বাংলাদেশ রোগীর সংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষা করার সক্ষমতার ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতাল পরীক্ষা না করেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে।

যথাক্রমে মে, জুন ও জুলাই মাসে করোনার বিস্তৃতির চিত্র।
যথাক্রমে মে, জুন ও জুলাই মাসে করোনার বিস্তৃতির চিত্র।

যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের (প্রায় ৮০%) মৃদু বা কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, তাই তাদের অজান্তেই অন্যদের মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯৪ থেকে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। এবং কতজন আক্রান্ত, তার সঠিক তথ্য জানতে আমাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে, যেন যেকেউ চাইলেই সহজে পরীক্ষা করাতে পারে। বাংলাদেশে যেহেতু স্বাস্থ্যসেবার বড় অংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে, তাই বেসরকারি খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যত দূর সম্ভব কোভিড-১৯ সেবার পরিধি বাড়াতে হবে।

যখন দ্রুত রোগী শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকে, তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশনে রাখা সম্ভব হয়, তখন রোগীর সংখ্যা কম থাকে (যেমন ভিয়েতনাম)। কিন্তু যখন পরীক্ষা করার সীমাবদ্ধতা থাকে, দ্রুত রোগীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না, তখন রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। যেহেতু কোভিড-১৯-এ বয়স্ক, বিশেষত ডায়বেটিস, হৃদ্‌রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগীদের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে, তাই পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা এবং কখনো কখনো আইসিইউর দরকার হয়। আমাদের দেশে শুধু না, এই উপমহাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ডাক্তার-রোগীর অনুপাত ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অনেক অংশে দুর্বল। কিন্তু জনসংখ্যা এবং জনঘনত্ব পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চল থেকে বেশি। আরও আছে দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। আমরা যদি বৈশ্বিক কোভিড-১৯-এর তথ্যের দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখব, কোভিড রোগীর সংখ্যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে দ্রুত যে ১০টি দেশে বাড়ছে, তার ৩টিই দক্ষিণ এশিয়ায় (বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান)। যদি কোনো কার্যকর ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার না হয়, তাহলে মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯ থামবে না।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে লকডাউন কেন? লকডাউন দরকার এই জন্য যেন রোগীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। অতিরিক্ত চাপ পড়লে প্রথমত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, দ্বিতীয়ত যাদের চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো সম্ভব হতো, তারা সেই সুযোগ পাবে না। তৃতীয়ত, লকডাউনের কারণে যে সময়টা পাওয়া গেল, সেই সময় যদি কোনো টিকা বা ওষুধ পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে অন্যদের সংক্রমণ বা মৃত্যু থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের যেহেতু মৃদু বা কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, তাই আক্রান্তের আসল সংখ্যা জানতে হলে আমাদের অ্যান্টিবডি পরীক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে কারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে একটা ধারণা আমরা পাব। একই সঙ্গে আমরা যদি মোট সংক্রমণের আসল সংখ্যা জানতে পারি, তাহলে কখন রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে, কখন নামতে শুরু করবে, এ সম্বন্ধে আমরা একটা অনুমান করতে পারব। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কবে নাগাদ অফিস, স্কুল, বাজার খুলে দেওয়া সম্ভব হবে, সে সম্বন্ধেও পরিকল্পনা করতে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি আমরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর সঠিক সংখ্যা জানতে না পারি, তাহলে কারও প্রেডিকশন মডেলই বাস্তবতার ধারে কাছে দিয়ে হয়তো যাবে না।

গত বছর আগস্ট মাসে যখন ডেঙ্গুর রোগীর সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, তখন থেকে একটা এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম তৈরি করার কথা লিখেছিলাম। এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমের কেন্দ্রে থাকে রোগী। এই ধরনের সিস্টেম দিয়ে প্রায় রিয়েল টাইমে রোগীর অবস্থান শনাক্ত এবং ক্লাস্টার নির্ণয় করা সম্ভব হয়। যত দ্রুত ক্লাস্টার শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তত ছোট পরিসরে রোগীদের কোয়ারেন্টিন করে রাখতে পারলে বাকিরা নিরাপদে থাকেন। কিন্তু মনে রাখা ভালো, এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমের কোনো একক মডেল নেই। একই মডেল সব দেশের জন্য কাজ করবে না। প্রত্যেক দেশকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং স্থানীয় অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে তাদের মতো করে সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম গড়ে তুলতে হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশ (ইউকেএইডের অর্থায়নে) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় এমন একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে এই প্রকল্পে কমিউনিটি পর্যায়ে কাজ করছে এসইইপি নামক একটি এনজিও। যদি মডেলটি সফলভাবে কাজ করে, তাহলে বড় পরিসরে মডেলটি এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে। সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম শুধু ম্যাপ তৈরি করাতেই সীমাবদ্ধ না, সেই ম্যাপ ও তথ্যের বিশ্লেষণ করে দ্রুত কর্মপরিধি ঠিক করা ও সম্পাদন করাটাই সবচেয়ে জরুরি।

ঢাকা মহানগরে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এলাকাভিত্তিক চিত্র।
ঢাকা মহানগরে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এলাকাভিত্তিক চিত্র।

কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে আইইডিসিআরের তথ্য ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রোগীর অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে ম্যাপ তৈরি করছে। কিন্তু ম্যাপ তৈরির পর করণীয় নির্ধারণ করতে এত দিন দেখা যায়নি। তবে আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে, সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বেশ কিছু এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই এলাকাগুলোকে ‘লকডাউন’ করা হবে। তবে আইইডিসিআরের তথ্যের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, অনেক বিস্তৃত জায়গাকে একটা এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেমন: মিরপুর, উত্তরা কিংবা ধানমন্ডি এলাকা। ধানমন্ডি কত নম্বর রোড, উত্তরা কত নম্বর সেক্টর বা মিরপুর কত নম্বর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সেই সুনির্দিষ্ট এলাকা যদি তথ্য থেকে চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে এই ব্যবস্থা খুব কার্যকর হবে না। কারণ, এত বিস্তৃত এলাকা নজরদারিতে রাখা সম্ভব না। তাই যত দ্রুত কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত ও তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্ণয় করে যত ক্ষুদ্র পরিসরে ক্লাস্টার চিহ্নিত করা যাবে, তত কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। তবে সবকিছুর জন্য যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সঠিক এবং দ্রুত তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। আইইডিসিআরকে এ ব্যাপারে আরও দক্ষতা দেখাতে হবে, প্রয়োজনে আরও লোকবল নিয়োগ করতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কার্যকরভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ১৪ বা ২১ দিন না, কঠোরভাবে কমপক্ষে ৪০ দিন লকডাউনে থাকতে হবে। এরপর যত দিন লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হবে, করোনাভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ ততটা কার্যকর হবে। তাই নীতিনির্ধারকেরা সঠিক ভাবে যদি দ্রুত কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে পারেন, তাহলে হয়তো আমরা ঝুঁকি কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হব।

আতিক আহসান: চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী