একটু বোঝান, গ্রামের মানুষও মাস্ক পরবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘বাজারে মাস্ক পরে যেতে আমার লজ্জাই করছে। সম্পূর্ণ বাজারে আমি একাই মাস্ক পরছি। সবাই আমার মাস্কের দিকে তাকায়।’ কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় কৃষিবিদ নূরুজ্জামান তাঁর বাড়ির পাশের একটি ছোট বাজারের অবস্থা প্রসঙ্গে এ কথা বলছিলেন। ওই উপজেলার আরও কয়েকটি ছোট বাজারে একই অবস্থা দেখলাম। উপজেলা ও জেলা সদরের বাজারগুলো সন্ধ্যার মধ্যে বন্ধ হয়। ছোট বাজারগুলোতে তাই সন্ধ্যার পর উপচে পড়া ভিড়। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো নিয়মই সেখানে পালন করা হয় না। যে কয়েকজনকে মাস্ক পরা দেখা যায়, তঁারাও মাস্ক পরেছেন থুতনিতে। অনেকেই পকেটে মাস্ক রাখেন এই ভেবে, যদি কখনো পুলিশ ধরে।

রাজারহাটের বোতলার পাড় গ্রামে এক তরুণকে দেখলাম মাস্ক পরে যেতে দেখে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, ‘করোনা আসার শুরুতে যখন শুনছি মাস্ক পরা নাগবে, তখন থাকি মাস্ক ছাড়া বাইরে যাই না।’ সাতক্ষীরার এক কলেজশিক্ষক মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে অটোরিকশায় সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জ সপরিবার গিয়েছিলাম। সারা পথে দু-একজন ছাড়া মাস্ক পরা কাউকেই দেখিনি। আমাদের মুখে মাস্ক দেখে সবাই তাকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমরা যেন ভিনগ্রহ থেকে আসছি।’

রংপুরের মূল শহরে কদিন আগেও মাস্ক পরা লোকের সংখ্যা ছিল অনেক কম। এখন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতরেই শহরের উপকণ্ঠের বাজারগুলোতে সতর্কতা–সচেতনতার বালাই নেই। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরে যেতে যতগুলো বাজার পেলাম, মাস্ক পরা মানুষ দেখলাম হাতে গোনা কজন। শত শত মানুষের জটলা, কারও মুখে মাস্ক নেই।

বাংলাদেশে কোভিড–১৯ মহামারি শুরুর পর কুড়িগ্রাম অঞ্চলে সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা দেখে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বোতলার পাড় গ্রামে ‘বোতলার পাড় গ্রাম সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গ্রামের সামর্থ্যবানেরা সামর্থ্যহীনদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সুরক্ষা কমিটি খাদ্যসাহায্য, চিকিৎসা, সচেতনতা বাড়ানো ইত্যাদি কাজ করছে। গ্রামের অসহায় মানুষের সহায় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্টের বাংলাদেশ প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনলাইনভিত্তিক কয়েকটি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক আছেন, তাঁরা ‘স্বেচ্ছাব্রতী’ গ্রামভিত্তিক অনেক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তাঁরা কোভিড–১৯ মহামারিকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দরিদ্র, অসহায় মানুষকে সহায়তা করছেন। ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থের সহায়তা দিয়েছেন। তাঁরা ‘করোনা–সহিষ্ণু গ্রাম’ গঠনের চেষ্টা করছেন।

দি হাঙ্গার প্রজেক্টের অনলাইনভিত্তিক অনুষ্ঠানে রংপুর, নওগাঁ, মেহেরপুর, বরিশাল, কক্সবাজারসহ বেশ কয়েকটি জেলার স্বেচ্ছাব্রতীর অভিজ্ঞতা শুনেছি। কক্সবাজারের স্বেচ্ছাব্রতী বেলাল উদ্দীন বলেন, কক্সবাজার জেলায় করোনার সংক্রমণ ব্যাপক; কিন্তু তাঁরা যে গ্রামে কাজ করছেন, সেখানে কম মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। তাঁরা তরুণ শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে কাজ করেছেন। জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, ইমামদেরও সঙ্গে নিয়েছেন।

অনেক গ্রামে স্বেচ্ছাব্রতীরা সংগঠিত হয়ে গ্রামের সামর্থ্যবানদের সহায়তা নিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁদের বসার জন্য কক্ষ দিয়েছেন। কোনো কোনো উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ত্রাণ বিতরণের কাজে স্বেচ্ছাব্রতীদের সহযোগিতা নিয়েছেন। ত্রাণসহায়তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজে তাঁরা মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। তাঁরা গ্রামের প্রকৃত অসহায় মানুষের খবর রাখেন।

করোনায় দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর দশায় পড়াই স্বাভাবিক। শহরের পাড়া-মহল্লায় এবং গ্রামে গ্রামে কোটি কোটি মানুষ নানবিধ সংকটে পড়ছে। কখনো খাদ্য, কখনো চিকিৎসাসংকট। সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকার তরুণ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। তরুণদের ব্যক্তিগত টাকা নেই। কিন্তু তাঁরা সংগঠিত হয়ে মহৎ উদ্দেশ্যে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সামর্থ্যবানদের কাছে সহায়তা চেয়ে শূন্য হাতে ফিরছেন না। সরকার যদি এই শক্তিগুলোর সমন্বয় সাধন করতে পারে, তাহলে করোনা সংকটকালে অসহায় মানুষের সহায়তার কাজগুলো আরও ভালোভাবে সম্পাদিত হতে পারে।

কোভিড–১৯ মহামারিতে গ্রাম সুরক্ষার ক্ষেত্রে বোতলারপাড় গ্রাম একটি দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের প্রতিটি গ্রামে একজন করে উদ্যোক্তা খুঁজে বের করতে পারলে তাঁদের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে অনেক স্বেচ্ছাসেবককে সংগঠিত করা সম্ভব। তরুণেরা এর বড় সহায়ক শক্তি। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজ নিজ গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা, কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য সহায়তামূলক কাজ করবেন। তাঁদের বেতন-ভাতা দিতে হবে না। বরং তাঁরা গ্রামে সামর্থ্যবানদের তালিকা প্রস্তুত করবেন, অর্থ সংগ্রহ করে সামর্থ্যহীনদের মধ্যে বিতরণ করবেন।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক