আমাদের ইতালির ভিসা ও হংকংবাসীর কপাল

কদিন আগে ইতালির রোম বিমানবন্দর থেকে বেশ কিছু বাংলাদেশি বিমানযাত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইতালির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশের কোনো যাত্রীকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ইতালিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সম্ভাব্য কারণ, অনেক বাংলাদেশি যাত্রী করোনায় সংক্রমিত ছিলেন। এর পরপরই আরেকটা বিমান রোমে পৌঁছাল বিভিন্ন দেশের যাত্রী নিয়ে। সেই বিমানে সোয়া শর বেশি বাংলাদেশি যাত্রীও ছিলেন। অন্য দেশের যাত্রীদের ইতালিতে পা রাখতে দেওয়া হলো আর আমাদের দেশের সব ভাই-বেরাদরকে ওই বিমানেই ফেরত পাঠিয়ে দিল। সেই সঙ্গে এবার এল আরও জোরালো ঘোষণা: ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কেউ ইতালিতে প্রবেশ করতে পারবে না। এই সুবাদে মানব পাচারকারীদের ব্যবসার প্রসার ঘটবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এই অধমের অজানা।

তবে এটা জানা আছে যে রোমের ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক আগে শেনজেনভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে তারাও আপাতত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না। আমাদের এক পাশের ভারতীয় ও অন্য পাশের মিয়ানমারের নাগরিকদের ভিসা দেবে, কিন্তু মাঝখানের বাংলাদেশিরা বাদ। মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ ২৬টি দেশ নিয়ে এই শেনজেন গোষ্ঠী। ভিসার দৃষ্টিকোণ থেকে এই শেনজেন গোষ্ঠীর বিরাট কেরামতি এ রকম: আপনি স্পেনে যেতে চান তাই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ভিসার দরখাস্ত স্প্যানিশ দূতাবাসে জমা দিলেন। তারা যাচাই-বাছাই করে আপনাকে ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তবে আপনার পাসপোর্টে শুধু স্প্যানিশ ভিসার পরিবর্তে সিল মারবে ‘শেনজেন’ ভিসা। অর্থাৎ স্পেন হয়ে শেনজেনের অন্তর্ভুক্ত যেকোনো এক বা একাধিক দেশে যেতে আপনার আর ভিসা লাগবে না। এক ভিসাই ২৬ দেশের জন্য যথেষ্ট। তবে আমাদের জন্য এখন ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো। ২৬ দেশের কোনোটাই আমাদের আপাতত ভিসা দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে দিন দিন। পশ্চিম থেকে পুবের দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানও ঘোষণা দিয়েছে তারাও বাংলাদেশিদের আপাতত ভিসা দেবে না।

কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না, কিন্তু যত দূর মনে পড়ে আশি-নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নাইজেরীয় নাগরিকদের ভিসা দিতে চাইত না। এখন মনে হয় আমরাও অপাঙ্‌ক্তেয়দের তালিকায় শীর্ষে উঠে যাচ্ছি। বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ইউরোপের বহু দেশে এই অধম ঘোরাফেরা করেছি ভিসা ছাড়াই। কারণ, তখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলে অনেক দেশ ভ্রমণের জন্য ভিসা লাগত না। এখন যেমন আমেরিকান পাসপোর্ট থাকলে দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশ ভ্রমণের জন্য ভিসা লাগে না। অবশ্য দু–একটা দেশ এখনো আছে, যেখানে ভ্রমণের জন্য আগেভাগে সেই দেশের ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে হয় না। ওই সব দেশের এয়ারপোর্টে পৌঁছালে আপনার পাসপোর্টে ভিসার সিল মেরে দেবে। যেমন শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া। আরও দু-তিনটা দেশ হয়তো আছে, কিন্তু খোঁজখবর না নিয়ে রওনা হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ওয়াকিবহাল পাঠক হয়তো খেয়াল করেছেন যে হংকংয়ের ওপর চীন ইদানীং খুব চোটপাট করছে। অল্প কিছুদিন আগে চীন হংকংবাসীর জন্য একটা নতুন আইন করেছে। সেটা আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো। সমালোচনা করা যাবে না, নেতাদের নিন্দা করা যাবে না, কটূক্তি, ব্যঙ্গ ও আরও অনেক কিছু লেখা, বলা বা আঁকা যাবে না। গত কয়েক মাসে হংকংয়ে অনেক মিছিল, সমাবেশ ও অন্দোলন হয়েছে চীনের জবরদস্তির বিরুদ্ধে। চীন এ নতুন আইনে বিধান করেছে যে দেশ-জাতির নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অনুমতি ছাড়া মিটিং-মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না। যে কথা বলা যাবে না বা যে মিটিং করা যাবে না, সেগুলো করলে তা হবে বিভিন্ন ধরনের দেশদ্রোহমূলক কাজ, ফলে বহুকাল থাকতে হবে সেই দেশের কাশিমপুর বা কেরানীগঞ্জের কারাগারে। চীনা নেতাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলেও একই পরিণতি হবে।

পাঠক এ অবস্থায় অবশ্যই মনে করতে পারেন হংকংবাসীরও তো কপাল পুড়েছে। তবে তা মনে করলে কিঞ্চিৎ ভুল হবে। চীনের ওই আইনের জাঁতাকলে পড়ে বহু হংকংবাসীই এখন প্রচণ্ড নাখোশ। বলতে, লিখতে, আঁকতে পারব না, সভা-সমিতি নেই, বাক্‌স্বাধীনতা নেই—এ কী মহাবিপদ! চীন এ আইন পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বিলাতি বরিস ভাইয়ের মহা তর্জন-গর্জন শুরু হয়ে গেল। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। সাবেক ঔপনিবেশিক প্রজাদের ওপর বরিস ভাইয়ের প্রচণ্ড ভালোবাসা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইতিমধ্যে সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে ৩০ লাখ হংকংবাসী যুক্তরাজ্যে গিয়ে এখনই স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে, কাজকর্ম করতে পারবে এবং এক বছর পর ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার জন্য দরখাস্ত করে পাঁচ বছর পর তা অর্জনও করতে পারবে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হংকংবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন: আপনারা ব্যবসা–বাণিজ্য করার জন্য এক্ষুনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসুন, অস্ট্রেলিয়ার দরজা আপনাদের জন্য খোলা। কানাডার জাস্টিন ট্রুডো এখনো কিছু বলেছেন কি না, চোখে পড়েনি। হংকংবাসীর জন্য তিনিও নিশ্চয়ই কানাডার দ্বার উন্মুক্ত করে দেবেন।

হংকংয়ের বর্তমান জনসংখ্যা ৭০ লাখ। ৩০ লাখ যুক্তরাজ্য নিয়ে গেলে বাকি ৪০ লাখ নেওয়ার জন্য কোনো কোনো দেশের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ না বাধলেও ঝগড়া-ফ্যাসাদ যে লাগতে পারে, তা বলা বাহুল্য।

তাই এই লেখার শিরোনামে আছে ‘হংকংবাসীর কপাল’। বিগত শতাব্দীর প্রথম দিকে জন্মগ্রহণকারী এই অধমের দাদি বা নানি অবশ্যই বলতেন হংকংবাসীর কপাল ভালো, তাই সবাই তাদের নিতে চাইছে। আমাদের কপাল খারাপ, তাই আমাদের জন্য সব দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আয়নায় অনেকক্ষণ ধরে আমাদের নিজেদের চেহারা দেখার সময় এসেছে। এককালে সবকিছুর জন্য আমরা ভিনদেশিদের দোষ দিতাম, তারপর দোষ দেওয়া শুরু করলাম সামরিক শাসকদের। তারপরও তো তিন দশক পেরিয়ে গেছে, একে অপরকে দোষারোপ করেই চলছি। এবং আরেকটা জাতীয় কাজ হলো নিজের ঢোল নিজেই পেটানো: দ্যাখো, দ্যাখো, আমরা কত শত ভালো ভালো কাজ করছি! দিন নেই, রাত নেই শুধু ভালো কাজই করে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর কেউই সেটা বুঝল না। না বোঝার কারণেই ইউরোপের দরজা আমাদের সবার জন্য বন্ধ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, এমনকি ভারতও বলছে লাখ লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে আছে।

যত দিন যাচ্ছে, অন্যদের কাছে আমরা তত বেশি অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যাচ্ছি। দিন–রাত উন্নয়নের বুলি আউড়ে আমাদের ভীষণভাবে সারাক্ষণ ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা আর দুর্নীতির কারণে আমরা এখন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, আমাদের এককালের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব ধরনের বিশ্বতালিকার তলানিতে (বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩টি হংকংয়ে)। বহু ধরনের, এমনকি জীবন–মরণ ইস্যুতেও আমাদের অনেকেই এখন প্রতারণা ও জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত। অচিরেই লাখ লাখ লোক ভীষণভাবে ক্ষুধার্ত হবে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজে আমরা এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি যাতে মাত্র কয়েক লাখ লোক দেশে-বিদেশে শতকোটি টাকার পাহাড় গড়েছে। তারা হয়তো সহজেই বিদেশে গিয়ে পার পেয়ে যাবে।

হংকংবাসীকে সবাই স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কপাল প্রতিদিনই পুড়ছে। অচিরেই বর্তমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ইত্যাদি মিলিয়ে বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ...।’

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক