বানান বিতর্কের আগে-পরে যা ভাবা উচিত

তর্ক চলছে এখন ‘গরু’ আর ‘গোরু’ নিয়ে। এর আগে ‘ইদ’ আর ‘ঈদ’ নিয়ে তর্ক চলেছে, যার সুরাহা এখনো অনেকে পাননি। বানান প্রসঙ্গে অতি পণ্ডিত এবং অতি অজ্ঞ সবার অংশগ্রহণ বিষয়টিকে আরও দ্বিধান্বিত করে তুলেছে। এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার নিশ্চয় সবার আছে; তবে বানানের কিছু মৌলিক ধারণা মাথায় নিয়ে কথা বললে তর্ক ‘কাজের তর্ক’ হয়ে ওঠে।

বানান শব্দের লিখিত চেহারা মাত্র। শিশু প্রথমে বর্ণ শেখে, পরে শব্দ ও বাক্যের স্তরে যায়। বর্ণ শিশুর কাছে ছবি আকারে ধরা থাকে; অর্থাৎ /ক্/ ধ্বনির জন্য ছবি ‘ক’, /খ/ ধ্বনির জন্য ছবি ‘খ’ প্রভৃতি। এমনকি শব্দকেও শিশু ছবি হিসেবে মনে রাখে। যেমন, ‘গরু’ শব্দটিকে সে একটি ছবি হিসেবে দেখে এবং তার মস্তিষ্ক এটিকে সাধারণভাবে একটি প্রাণী হিসেবে মেনে নেয়। এ কারণে বানানের রূপবদল মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না; কারণ তাতে মস্তিষ্কে ধারণ করা ছবির বদল ঘটে। এর ফলে গরুকে ‘গোরু’ লিখলে তার কাছে বানানটিকে ‘অশুদ্ধ’ মনে হয়।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, স্কুলে যে বানান লিখলে শিক্ষক ভুল বলে কেটে দিতেন, এখন সেসব বানানকে শুদ্ধ বলে অভিধানে জায়গা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগে অংশগ্রহণ করতে গিয়েও বানান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। তখন শিক্ষকদের বলতে শুনেছি, সাইনবোর্ডে ভুল বানান থাকলে আলকাতরা দিয়ে কেটে দেওয়া উচিত। অনেকে বলেছেন, এত এত বানান ভুল, বাংলা একাডেমি ঘুমাচ্ছে নাকি? এমনও বলেছেন অনেকে, বানান ভুলের জন্য জরিমানা করা উচিত। এসব কথায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপস্থিত অভিভাবকেরাও হাততালি দিয়ে উঠেছেন। বাংলা বানান নিয়ে দীর্ঘ কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, বানানের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া ঠিক নয়। এমনকি, চূড়ান্ত বিচারে বানানকে ‘শুদ্ধ’ বা ‘অশুদ্ধ’ বলা যায় কি না, এই প্রশ্ন রয়েছে।

ভাষাবিদগণ বাংলা বানান নিয়ে বহু রকম প্রস্তাব দিয়েছেন; এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো বিপ্লবাত্মক। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ রকম বাংলা লেখারও প্রস্তাব দিয়েছেন: অেকদা অে’ক সৃগাল দ্রাক্ষা ক্ষেত্রে প্রবেশ করিল’। দ্রাক্ষাফল অতি মধুর। শুপক্ক ফলশকল দেখিয়া অৈ ফল খাইবার নিমিত্ত সৃগালের অতিশয় লোভ জন্মিল’। আবার মুহম্মদ আবদুল হাই মনে করেন, যেখানে ব-ফলার কোনো উচ্চারণ নেই, সেখানে ব-ফলাকে বাদ দেওয়া যায়; যেমন ‘ত্বক’কে তক, ‘জ্বালা’কে জালা প্রভৃতি। তিনি ‘পদ্ম’কে পদ্দ, ‘আত্মা’কে আঁত্তা লিখতে চান। এ ধরনের হাজারো প্রস্তাব রয়েছে। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ভাষার প্রবণতা এই যে, একসঙ্গে অনেকখানি বদল সে মেনে নিতে পারে না। ফলে, বানানের কোনো মূলনীতি যদি ঠিকও করা সম্ভব হয়, এর প্রয়োগ ঘটাতে হয় অনেক ধীরে। আর যেকোনো পরিবর্তনের উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলে ভালো হয়।

ইদানীং বাংলা বানান নিয়ে তর্ক উঠলে অনেকেই বুঝে না-বুঝে বাংলা একাডেমিকে আক্রমণ করে বসেন। বাংলা একাডেমি একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র; সেখানে কাজের জন্য প্রায় ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালের বানান কমিটিতে এবং এর আগে-পরে বিভিন্ন অভিধান প্রণয়নের কাজে যাঁরা ছিলেন, সেই নামগুলো লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন। ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের দুর্বলতা থাকতে পারে; সেই দায় নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানেরও আছে; তবে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সব ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত হয় না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে ধর্ম্ম, কর্ত্তা প্রভৃতি শব্দকে বদলিয়ে ধর্ম, কর্তা গ্রহণ করতে বলার পরে দেবপ্রসাদ ঘোষের মতো অনেকেই তখন মেনে নিতে পারেননি। এখন পর্যন্ত কলকাতায় অসংখ্য নতুন সাইনবোর্ডে আপনি দেখতে পাবেন ‘ধর্ম্ম’, ‘কর্ত্তা’ বানান। এমনকি সম্প্রতি রং করা অনেক গাড়ির গায়েও বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘ধর্ম্মতলা’।

বানানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাঙলা’র বদলে ‘বাংলা’ বানানকে জনপ্রিয় করেছেন। আবার সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আবদুল হাই, এনামুল হক, হুমায়ুন আজাদ সারা জীবন রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেই ‘বাঙলা’ লিখে গেছেন। তাহলে ‘বাঙলা’ ঠিক, নাকি ‘বাংলা’? প্রয়োগের ব্যাপারে একটি বানানকে অধিকতর উপযোগী বা যথার্থ বলেছেন ভাষাপণ্ডিতেরা। তাঁরা আরেকটিকে ভুল বলেননি। অথচ বানান নিয়ে প্রচলিত ধারণায় ত্রুটি থাকার কারণে প্রায় সব মানুষ একটি বানানকে ‘শুদ্ধ’, আরেকটিকে ‘অশুদ্ধ’ মনে করেন। ফলে তর্ক ওঠে ‘ইদ’ ঠিক, না ‘ঈদ’? ‘গরু’ না ‘গোরু’? এ রকম তালিকায় পড়তে পারে ‘কুরবানি’ না ‘কোরবানি’; ‘ওজু’ না ‘ওযু’; ‘শিয়াল’ না ‘শেয়াল’ প্রভৃতি অজস্র বানান। সব শব্দ একক বানান নিয়ে চলে না। কোনো কালে একটি বানান অধিকতর ব্যবহৃত হয় মাত্র। একসময় পাখি-পাখী, স্টার-ষ্টার প্রভৃতি বানান নিয়েও তর্ক চলেছে। মনসুর মুসার মতো কারও কারও চিন্তায় ওই তর্কের অবসান হয়নি। বানানের নতুন রূপ দেখে মনে করা ঠিক নয়, আগে আমরা অনেক বানান ভুল লিখতাম, এখন ঠিক লিখি। কিংবা আগে অনেক বানান ঠিক লিখতাম, এখন ভুল লিখি। বাংলা একাডেমির বানান বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মান্য করার বিধান রয়েছে; জাতীয় পাঠ্যপুস্তকেও সেই বানানের প্রতিফলন ঘটে। ফলে ‘গরু’ বানানে অভ্যস্ত এই প্রজন্ম ‘গোরু’ দেখে যেমন ‘অশুদ্ধ’ মনে করছে; তেমনি একাডেমির সুবাদে পরবর্তী প্রজন্ম আবার ‘গোরু’ বানানেই অভ্যস্ত হয়ে গেলে ‘গরু’ বানানকে ‘অশুদ্ধ’ মনে করবে।

পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষার মতো বাংলা বানানও পুরোপুরি উচ্চারণমূলক নয়, আবার ব্যুৎপত্তিমূলক নয়। এই দুই মতের ব্যক্তিরাও জানেন, বানানকে পুরোপুরি ব্যুৎপত্তি-অনুসারী বা পুরোপুরি উচ্চারণ-অনুগ করা সম্ভব নয়। বানানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রীতি বা নীতি দাঁড় করানোও কঠিন। তাই প্রথাকে অনুসরণ করা সবচেয়ে ভালো সমাধান। একজন অল্পশিক্ষিত ব্যক্তি ‘ভুল’ বানানে কিছু লিখলে তাঁর সমালোচনা বাদ দিয়ে সমালোচনা করুন ওই ইংরেজি-শিক্ষিত ব্যক্তির, যিনি মনে করেন বাংলা কোনো কাজের ভাষা নয়।

*তারিক মনজুর সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়