নদী দুস্থ বলে ভাসাচ্ছে, মানুষ দুস্থ বলে ভাসছে

ভরাট হওয়া তিস্তা বন্যার পানি ধরে রাখতে পারছে না বলে দুই কূলে এমন বন্যা। ছবি: ফাইল ফটো
ভরাট হওয়া তিস্তা বন্যার পানি ধরে রাখতে পারছে না বলে দুই কূলে এমন বন্যা। ছবি: ফাইল ফটো

আমাদের ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে আমরা কোনো বছর এসব বন্যা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। যাঁরা নদী কিংবা বন্যা ব্যবস্থাপনাবিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তাঁদের কাউকেই বন্যায় বাঁধের রাস্তায় ঠাঁই নিতে হয় না। তাঁদের নয় মাস ধরে গুছিয়ে তোলা সংসার প্রতিবছর বন্যার তিন মাসে ধ্বংস হয় না। তাঁরা বন্যার্তদের করুণ জীবন উপলব্ধি করে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন না। নীতিনির্ধারকেরা থাকেন বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবছর দেশের সব জেলায় দুর্যোগকালীন কিছু সহায়তা দিয়ে থাকে। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। যে জেলায় বন্যা, খরা, অগ্নিকাণ্ড কিংবা কোনো দুর্যোগ হয়নি, সে জেলার জন্যও যত মেট্রিক টন চাল, আবার যে জেলার চার ভাগের তিন ভাগ পানির নিচে, তিন দফায় অন্তত মাসখানেক ডুবে থাকবে, সে জেলার জন্যও সেই বরাদ্দ। বন্যার্ত জেলাগুলোর জন্য কিছু বাড়তি ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। করোনায় যারা সবচেয়ে দুস্থ ছিল বন্যার আঘাতও তাদের জন্যই সবচেয়ে বেশি। যেহেতু বেসরকারি সহায়তা এ বছর নেই বললেই চলে, তাই সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে অনেক গুণ।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর প্রতি সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিগত অবহেলা চূড়ান্ত পর্যায়ের। প্রতিবছর লাখ লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। কত সম্পদ যে নষ্ট হয় তার ইয়াত্তা নেই। নদীর তলদেশ ভরাট হয়, যা পরের বছর বন্যাকে আরও ত্বরান্বিত করে। অথচ এসব থেকে উত্তরণের চেষ্টা অত্যন্ত ক্ষীণ। নদীতীরবর্তী বন্যাপ্রবণ এলাকায় একটি কথা প্রচলিত আছে ‘বছরে নয় মাসের স্বপ্ন-সঞ্চয় তিন মাসে বন্যায় খায়’।

ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ কয়েকটি নদ–নদীর পানি রংপুর অঞ্চলের বন্যার প্রধান কারণ। নদীগুলোর দুপাড়ে প্রতিবছর একাধিকবার বন্যা হয়। উজান থেকে নদীতে প্রচুর পলি আসে। বন্যায় দুপাড় ভাঙা মাটিগুলো নদীর বুকে জমা হয়। শুষ্ক নদীর বুকজুড়ে মেশিন দিয়ে বিভিন্ন রকম শস্য চাষ করার কারণে তলদেশ শক্ত হয়। ফলে পানির স্রোতে নদী গভীর হতে পারছে না। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় তিস্তার ৭০ কিলোমিটার নদী পানিহীন পড়ে থাকে। হঠাৎ করে যখন ভারত পানি ছেড়ে দেয়, তখন অকস্মাৎ বন্যা দেখা দেয়।

নদীতীরবর্তী অনেক স্থানেই নদীর তলদেশের চেয়ে পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমিই নিচু। লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের উত্তর ডাউয়াবাড়ি গ্রামের নদীকর্মী ছাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘নদীর তলদেশ আমাদের সমতল জমির চেয়ে অনেক উঁচু। ফলে নদীতে পানি আসার সাথে সাথেই সমতল ভূমি প্লাবিত হয়।’ এ অবস্থা তো এক দিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে পলি জমে জমে এই অবস্থা হয়েছে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের দেশের নদীগুলোর যে গভীরতা ছিল তা তো মানুষের খনন করা নয়। পানি প্রবাহের বেগ নদীর তলদেশ প্রাকৃতিকভাবে খনন করার কাজ করে। পানির বেগ কমে গেলে পলি জমে যায়।

এক-দেড় কিলোমিটার প্রস্থের তিস্তা এখন ১০ কিলোমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রস্থ হওয়ার পরও পানি বহন করতে পারে না। তাহলে গভীরতা কত কমে গেছে সহজে অনুমান করা যায়। কয়েক বছর আগে এক বন্যায় তিস্তা ব্যারাজে গিয়েছিলাম। সেখানেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মচারী বলছিলেন, ‘এখানে যত পানি দেখছেন পানি এত নয়। হেঁটে পার হওয়া যাবে। শুষ্ক মৌসুমে দেখেছি তলদেশ অনেক উঁচু।’ গত সোমবার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীতে গিয়েছিলাম। সেখানেও স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, নদীতে যত পানি দেখছেন, তত নয়। গভীরতা খুব অল্প। শুধু তিস্তা নয়, প্রায় সব নদীরই একই অবস্থা। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, ফুলকামার, গঙ্গাধর, গদাধর, দুধকুমারসহ সব নদীরই একই অবস্থা।

নদীরক্ষা বাঁধের নামে অনেকগুলো শাখা নদীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে শাখা নদী আর পানি বহন করতে পারছে না। যেমন আগে তিস্তা নদীর শাখা ছিল ঘাঘট ও মানাস। এখন এ দুটো নদীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া আছে। ধরলা নদীর শাখা ছিল অর্জুনের ডারা, পাঁচগাছির ছড়া। এখন এ দুটোরও মুখ বন্ধ। নদী যেহেতু পানি ধারণ করতে পারে না, তাই বাঁধ ভেঙে অথবা পাড় উছলে বন্যা ডেকে নিয়ে আসে।

কত অযত্নের ফল যে আমাদের বন্যা তা বলে শেষ করা যাবে না। নদীরক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমতলের পানি নদীতে কীভাবে প্রবেশ করবে তার ব্যবস্থা নেই। জয়পুরহাটের পাশ দিয়ে তুলসীগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি খনন করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। নদীর মাটি দুপাশে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পানি নদীতে প্রবেশের পথ রাখা হয়নি বলে সেখানে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। রংপুরের খোকসা ঘাঘট নদ খনন করার পর দুপাশে বালু তুলে রাখা হয়েছে। সামান্য বৃষ্টির পানিতে ফসল ডুবে যাচ্ছিল। পরে স্থানীয় ব্যক্তিরা সেই পাড় কেটে ফসল রক্ষা করেছেন। আমাদের নদীরক্ষা বাঁধের সঙ্গে অনেকগুলো স্লুইসগেট ছিল সেগুলো এখন কার্যত অচল।

বন্যা কখনোই হবে না এ কথা বলা কঠিন। কিন্তু বন্যা যে আমাদের নিজেদের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এ কথা স্বীকার না করলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো পথ নেই। আমাদের অনেক নদীর প্রস্থ বেড়েছে। পূর্বে এগুলো প্রস্থে এত বড় ছিল না। প্রস্থে বেড়েছে শুনলে মনে হতে পারে নদী বড় হয়েছে। প্রকৃত অর্থে নদী প্রস্থ বেড়ে শক্তি অনেকটাই খুইয়েছে। আর এর প্রধান কারণ আমরাই। নদীর জন্য গভীরতা প্রয়োজন। প্রস্থে বৃদ্ধি নয়।

সরকারিভাবে কখনোই বন্যা দূর করারও যেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তেমনি বন্যায় কী কী প্রয়োজন, সেই তালিকাও করা হয়নি। বন্যার্তদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা অপ্রতুল। গবাদিপশুর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বীজতলা ডুবে গেলে বীজ পাওয়ার ব্যবস্থা থাকে না। সড়ক ভেঙে গেলে অবহেলিত জনপদের ভেঙে যাওয়া সড়ক কিংবা বাঁধ ঠিক করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। বন্যার্ত শিক্ষার্থীদের কথা আমলে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় না। চরাঞ্চলের জন্য বিশেষ অর্থ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। গর্ভবতী নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা এ সময়ে সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করেন।

প্রখ্যাত কথাশিল্পী দেবেশ রায় তিস্তাপুরাণ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘নদীকে তুমি মনে না রাখলে, নদী তোমাকে মনে রাখে। নদী ভুলে তুমি যদি পথে পা দাও, নদী তাহলে তোমার পথে উঠে আসবে।’ আমরা আমাদের নদীকে মনে না রাখার কারণেই আজ নদী আমাদের পথে উঠে এসেছে। ভবিষ্যতেও যদি আমরা নদীর কথা মনে না রাখি তাহলে আরও অনেক বড় খেসারত দিতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।
[email protected]