'বলো বাপু' শুনব না আর

এমাজউদ্দীন আহমদ
এমাজউদ্দীন আহমদ

এমাজউদ্দীন স্যারের মৃত্যুর খবর শুনতেই কানে বেজে ওঠে, ‘আচ্ছা বাপু’ অথবা ‘বলো বাপু’। এই দুটি শব্দ ওনার মুখ দিয়ে শুনেছি অসংখ্যবার। তাঁর ছাত্র বা কনিষ্ঠদের অনেকেই এই শব্দ দুটির সঙ্গে পরিচিত।

আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া এই শিক্ষাবিদের ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। নরম ভাষায় কথা বলতেন। যুক্তির বাইরে যেতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে (১৯৯২-১৯৯৬) ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা দাবি নিয়ে তাঁর সামনে যাওয়ার পর ছাত্রনেতাদের চুপসে যেতে দেখতাম। ওনাকে রাগতে দেখিনি, খ্যাপতেও দেখিনি। তিনি উপাচার্য থাকার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছি, ওনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই মূলত সে কারণেই।

এমাজউদ্দীন আহমদ উপাচার্য থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তপ্ত অবস্থায়। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নতুন আবহ, ক্ষমতায় বিএনপি। বিএনপির প্রথম দুবছর উপাচার্য ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা। এরপর আসেন এমাজউদ্দীন আহমদ। সরকারি ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের তখন সীমাহীন দৌরাত্ম্য, ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দলও। বিরোধী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তখন টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত। ক্যাম্পাসে প্রায়ই গোলাগুলি, ক্ষোভ-বিক্ষোভ লেগে থাকত। এখনকার মতো ক্যাম্পাস তখন একপক্ষের দখলে ছিল না। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ছিল দাপটের সঙ্গে। হলগুলোতে সহ-অবস্থানে কিছুটা ঘাটতি ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ের মতো ভিন্নমতের ছাত্রদের হল ছেড়ে যেতে হয়নি। এ নিয়ে ছাত্রদলের ক্ষোভ ছিল এমাজউদ্দীন আহমদের ওপর। ছাত্রদল চাইত, উপাচার্য তাদের পক্ষেই থাকবে। কিন্তু এমাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য লক্ষ করতাম। সবাই তাঁর কাছে ছিল আগে ছাত্র, পরে তার মতাদর্শগত পরিচয়।

মনে পড়ে, ১৯৯৪ সালের মার্চে ছাত্রলীগ ওনার কার্যালয় ভাঙচুর করেছিল। তখন ওনার সহনশীলতা দেখার সুযোগ পাই। আবার ১৯৯৫ সালের দিকে ছাত্রলীগের একজন ক্যাডার ওনার কক্ষে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এত বড় অপরাধের পর কেন কোনো ব্যবস্থা নেননি? ওনার জবাব ছিল, ‘আমি পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ও তো আমার ছাত্র।’ পরে শুনেছি, তিনি ওই ক্যাডারকে অনেক বুঝিয়ে তাঁর ক্ষোভ মিটিয়ে কক্ষ থেকে বিদায় করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রটিও উপাচার্যের কাছে ভুল স্বীকার করেছিল।

তখন ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ছিল ছোট একটি কক্ষের মধ্যে। নব্বইয়ে এরশাদ পতনের পর গণতান্ত্রিক আবহ শুরু হলে একের পর এক সংবাদপত্র প্রকাশ হতে থাকে, প্রতিটি পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার থাকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির ছোট কক্ষে আমাদের বসার জায়গা হতো না। টিএসসির পরিচালক তখন আলমগীর ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারদের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। তিনি চেষ্টা করলেও পাশের কক্ষটি আমাদের দিতে পারছিলেন না। আমরা দল বেঁধে উপাচার্যের কাছে যাই। অনেক দেনদরবার করে তিনি কক্ষটি সাংবাদিক সমিতির নামে বরাদ্দ করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিক সমিতিকে অনুদান দেওয়া হতো ২০ হাজার টাকা। আমরা একদিন দল বেঁধে গিয়ে স্যারকে বললাম, বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ। আমরা ৫০ হাজার টাকা বার্ষিক অনুদান চাইলাম, উনি ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিলেন।

একজন উপাচার্য হিসেবে ওনার বড় গুণ ছিল, সব সময় তাঁকে পাওয়া যেত। ওনার বিরুদ্ধে লিখলেও ক্ষুব্ধ হতেন না। বিনয়, ভদ্রতা, শিষ্টাচার—এসবের দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। বড় ঘটনা ঘটলেই বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টাররা দল বেঁধে ওনার বাসভবন বা কার্যালয়ে গিয়ে হাজির হতাম। উনি কথা বলতেন। লুকিয়ে থাকতেন না, এড়িয়ে যেতেন না।

সেই নব্বইয়ের দশক থেকে আজও পর্যন্ত মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় এতটুকু কমতি হয়নি। ফোন করলেই বলতেন, ‘বলো বাপু’। ওনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-পরবর্তীকালে কথা হতো মূলত গণতন্ত্র বা রাজনীতি নিয়ে। প্রায় সব গণমাধ্যমের এ-সংক্রান্ত খবরে ওনার উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হতো। প্রতিবেদন সমৃদ্ধ করতে বা লেখায় ভারসাম্য আনতে ওনার মন্তব্য বা মতামত আর পাওয়া যাবে না।

স্যারের মধ্যে আর যে গুণ ছিল, তা হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বিরোধী মতের সমালোচনায় তাঁর বক্তব্যে থাকত যুক্তি ও গঠনমূলক পরামর্শ। শেখ মুজিবুর রহমানকে উনি বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেই কথা বলতেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কথা বলতেন।এখনকার সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা উনি যুক্তির মাধ্যমেই করতেন।         

জীবনভর এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। পরিচয় ছিল বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবী হিসেবে। দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছেন সব সময়। সরাসরি বিএনপির কোনো পদে না থাকলেও দলটি তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিত। বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত শত নাগরিক কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অস্বস্তি ছিল সব সময়। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেছেন। এই সম্পর্ক যে বিএনপির জন্য ক্ষতিকর, এটা বলতে দ্বিধা করেননি। যদিও বিএনপি তাঁর এই পরামর্শ শোনেনি।

রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে প্রায় চার দশক ধরে কাজ করেছেন এমাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এখন এ দেশে বিরল—এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, তুলনামূলক রাজনীতি; রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট, সমাজ ও রাজনীতি, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। সংবাদপত্রে কলাম লিখেছেন; সুস্থ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন।

আত্মসম্মানবোধের পরিচয় দিয়ে গেছেন এমাজউদ্দীন আহমদ। যত দূর জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচজন উপাচার্য স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। এঁদের একজন ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে প্রথম পদত্যাগ করেছিলেন মাহমুদ হুসেইন, তিনি ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে পদত্যাগ করেছিলেন। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯৮৬ সালে মোহাম্মদ শামসুল হক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের অন্যায় আদেশ না মেনে পদত্যাগ করেছিলেন। আর ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের চাপে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী।

১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর একজন প্রভোস্ট নিয়োগকে কেন্দ্র করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মরহুম এ এস এইচ কে সাদেকের সঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে পদত্যাগ করেছিলেন উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। এ বিষয়ে তিনি খোলামেলা কোনো অভিযোগ করেননি। আমরা যতবার তাঁর কাছে পদত্যাগের কারণ জানতে চেয়েছি, তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে পদত্যাগ করেছেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তিনি বাইরের অনুরোধে প্রভোস্ট নিয়োগ করতে চাননি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রভোস্ট নিয়োগের একক ক্ষমতা উপাচার্যের। সেখানে বাইরের হস্তক্ষেপ তাঁর পছন্দ হয়নি। একজন কোমল ও মৃদুভাষী ব্যক্তি যে এমন সুদৃঢ় অবস্থান নিতে পারেন, তা-ও একজন প্রভোস্ট নিয়োগের মতো ইস্যুতে—এটা ছিল আমার মতো ওই সময়ের অনেক তরুণ রিপোর্টারের কাছে ভাবনার বিষয়।

 শরিফুজ্জামান সাংবাদিক
[email protected]