উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে আর কত অনিশ্চয়তা?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

২০২০ সালের শুরুটাই হয়েছে এক চরম আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে। কারণ হঠাৎ করেই করোনা বা কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব।

দুনিয়াজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশে এই রোগ প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তত দিনে ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া মাধ্যমিক ও দাখিল পরীক্ষা গ্রহণ শেষ হয়ে যায়। ১৭ মার্চ সরকার জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়াতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে। সেটি ছিল খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী তখনই ঘোষণা করেন, সেপ্টেম্বরের আগে হয়তো পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব হবে না। তাঁর সে অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

মার্চের মাঝামাঝি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের মূল কারণ ছিল দুনিয়াজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়া এবং তাই নিয়ে তৈরি হওয়া আতঙ্ক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে মানুষ বেশি দিন ঘরে থাকতে পারে না। মানুষ শুধু চিন্তাশীল প্রাণী নয়। আরও যেসব বিশেষণে মানবজাতি ভূষিত তা হলো, তারা একই সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাণী। কিন্তু এসব অভিধার মূলে আছে মানুষের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা। গ্রিক দার্শনিকেরা মানুষকে অভিহিত করেন ‘হোমা এডুকেটাস’ অর্থাৎ শিক্ষিত প্রাণী বলে। অন্য সব প্রাণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের চাবিকাঠি হলো এই শিক্ষা। মানুষ হলো দুনিয়ায় একমাত্র প্রাণী, যাকে শিখতে শিখতে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে হয়।

কথা হচ্ছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে। আমরা জানি ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা গ্রহণের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সরকারের সিদ্ধান্ত হলে এ পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। সরকার জনস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে সব বিষয় খতিয়ে দেখছে। সেটিই স্বাভাবিক। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নিজে একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক। কাজেই এ বিষয়ে তাঁর মতামত বিশেষজ্ঞ মতামত হিসেবে মানুষ গ্রহণ করবে।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ক্লাস শেষ হয়েছিল সরকারি ছুটি ঘোষণার আগেই। তাই এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। বরং পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তাঁদের প্রস্তুতিতে ঘুণ ধরছে। বাড়ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাও। সে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরীক্ষার্থীদের মতোই শিক্ষক, অভিভাবকদেরও। অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপও বাড়ছে। আর অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে তরুণ পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। তাই পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সবাই এখন দ্রুত পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে। যত দেরি হবে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে।

এ রকম পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করা যায়, ততই মঙ্গল। কিন্তু এর সঙ্গে কয়েকটি বড় প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। কেউ কেউ পরীক্ষার বিষয় কমিয়ে পরীক্ষা নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, মোট নম্বর অর্ধেক করে পরীক্ষা নিতে, যেমনটি স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রবল ভিন্নমত আছে। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধী ছিলেন। এবং তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি সে সময়ের এই সিদ্ধান্তকে ‘মারাত্মক ভুল’ ও ‘আত্মঘাতী’ বলে বর্ণনা করেছেন। ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে সীমিত বা কনডেন্সড সিলেবাসে পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে মেধাবী ছাত্রদের সে গ্লানি সারা জীবন ভোগ করতে হয়েছে। তাই একই ভুল দুবার করা উচিত হবে না।

তবে অন্য কয়েকটি ব্যবস্থা সুফল দিতে পারে। যেমন পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়ানো। তবে এর সঙ্গে বোর্ডের এমন কিছু অতি গোপনীয় বিষয় যুক্ত যে একটা পর্যায় যদি পার হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কেন্দ্র বাড়ানো সম্ভব না-ও হতে পারে। সেটি আন্তশিক্ষা বোর্ড ভালো জানে। তাদের পরামর্শ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল্যবান। শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা পরিচালনায় আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করি, প্রত্যেক কেন্দ্রের পাশে বোর্ড সাব-সেন্টারের অনুমতি দিতে পারে এবং যেসব কেন্দ্রে সাব-সেন্টার আছে, দরকার হলে সেখানে সাব-সেন্টার বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবকাঠামো এখন খুবই উন্নত। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত এ ধরনের পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত। এই ব্যবস্থা নিলে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো যাবে বলে আমার ধারণা। তবে এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিষেজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণই উত্তম।

দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হলো, পরীক্ষা আগের মতোই দীর্ঘদিন (৪৩-৪৪ দিন) ধরে না নিয়ে ১০ থেকে ১২ দিনে শেষ করা যায় কি না, সেটি বিচেনা করা। আমাদের কালে আমরা সকাল-বিকেলে দুটো করে পরীক্ষা দিয়েছি। সেই ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি দীর্ঘদিনের। যদিও শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের একটি অংশের তাতে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এটিই উত্তম ব্যবস্থা। দ্রুত পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে অভিভাবকদের আর্থিক সাশ্রয় ও পরীক্ষার্থীদের মানসিক শান্তি ফিরে আসে।

আমাদের মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ ভাগের নিচে। কাজেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবহারিক পরীক্ষা গ্রহণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

দেশে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই আশাব্যঞ্জক। বরং তরুণেরা এ প্রযুক্তি ব্যবহারে অধিক দক্ষ। তরুণ শিক্ষকদের প্রায় সবাই এ প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। আমার ধারণা, বর্তমানে দেশে খুব বেশি হলে ১৫ ভাগ শিক্ষক, যাঁরা খুবই সিনিয়র, তাঁরা এ প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারেন। তবে তাঁরাও একেবারে অদক্ষ নন। ফলে পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রণয়ন ও প্রকাশে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

আমি মনে করি, সময় এসেছে যখন সরকার সব অংশীজনের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করতে পারে। সেপ্টেম্বর মাসেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারলে ভালো হয়। তাহলে পরীক্ষার্থীদের উদ্বেগ কমবে এবং ভালো প্রস্তুতি নিতে পারবে। হঠাৎ অসুস্থতা বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণে যদি কোনো পরীক্ষার্থী সব পরীক্ষা শেষ না করতে পারে, তাহলে তাদের জন্য বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমন সুযোগ ১৯৯০ দশক পর্যন্ত চালু ছিল। বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও সাফল্যের সঙ্গে এখন তা করা সম্ভব।

পরীক্ষার সঙ্গে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় অতি গুরুত্বপূণ। বর্তমান সংকটে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আশা করি, এ সমস্যা সমাধান করতে সরকার অনতিবিলম্বে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]