শিশুর ওপর করোনার অভিঘাত

করোনাভাইরাস মহামারির পর সারা বিশ্বে এক কোটি শিশু আর বিদ্যালয়ে ফিরবে না বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের গবেষণায় যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, সেটি আমাদের জন্যও বেশ উদ্বেগজনক।

সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এবং শিক্ষা তহবিল কমে যাওয়ার কারণে এটি ঘটবে। দুই দিক থেকেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা জরিপে দেখা যায়, করোনার অভিঘাতে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার দরিদ্রের কাতারে চলে এসেছে। দারিদ্র্যের হার ২২ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। করোনাকাল দীর্ঘস্থায়ী হলে দরিদ্র ও কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

তবে কিছুটা স্বস্তিদায়ক হলো সেভ দ্য চিলড্রেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যে ১০টি দেশের নাম বলেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। দেশগুলো হলো নাইজার, মালি, লাইবেরিয়া, আফগানিস্তান, গিনি, মৌরিতানিয়া, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সেনেগাল ও আইভরি কোস্ট। করোনা বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষার ওপরই কেবল অভিঘাত তৈরি করেনি; স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিতেও তারা খুব নাজুক অবস্থায় আছে। এ ব্যাপারে এখনই সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

 বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দোরগোড়ায় এসেও আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।

যেসব অভিভাবকের ঘরে খাবারই নেই, তাঁরা কীভাবে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন? সরকার খানা জরিপ করে প্রতিটি পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করতে পারে। বিদ্যালয় থেকে শিশুর ঝরে পড়া রোধে সরকার আগে থেকে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে পারিনি। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগের কাছাকাছি থাকলেও এদের বড় একটা অংশ ঝরে যায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আগেই। করোনা সেই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে।

 এখন সরকারের প্রথম দায়িত্ব হলো করোনার কারণে যাতে কেউ ঝরে না পড়ে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়া। এরপরও যারা ঝরে পড়বে, তাদের কীভাবে ফের বিদ্যালয়মুখী করা যায়, সেই কর্মপরিকল্পনাও এখন ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা ও খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষার মতো কর্মসূচিগুলো নতুন করে জোরদার ও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার সংখ্যা কমে গিয়েছিল, তার পেছনের কারণ হচ্ছে মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া এবং স্কুলে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা সব বিদ্যালয়ে করা যায়নি।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭২ শতাংশ। এর অর্থ ১৭ কোটি মানুষের দেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা ছিল।

করোনা কেবল বাংলাদেশ নয়, সব উন্নয়নশীল দেশকেই বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই ঝুঁকি কমিয়ে আনার উপায় হলো বিদ্যালয়গামী প্রতিটি শিশুর আর্থিক অবস্থা পরিমাপ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া। এমনকি অভিভাবকদের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। অর্থাৎ যেসব অভিভাবক শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন, তাঁরাই করোনাকালীন সহায়তা পাবেন।

এ ধরনের কর্মসূচি সফল করতে হলে সরকারকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যয় কমিয়ে শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য বাড়তি বরাদ্দ রাখা হোক। করোনার আগে বিদ্যালয়ে যেত, এ রকম কোনো শিশুকে করোনার পরে বিদ্যালয়ের বাইরে রাখা যাবে না।