করোনা শনাক্তকরণে জালিয়াতি

কোভিড–১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ দেশের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার কী শোচনীয় দুর্দশা। সংক্রমণ রোধে ব্যর্থতা এবং কোভিড–১৯ রোগীসহ সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়া সাধারণ চোখেই দৃশ্যমান। মহামারি মোকাবিলার জন্য বরাদ্দ অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতিও আর গোপনীয় বিষয় নয়। তবে যা জানা ছিল না, তা হলো মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে রাজধানীর গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়াই করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ব্যবসা এর সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। 

কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে যেসব প্রতারণামূলক তৎপরতার খবর কিছুদিন ধরে প্রকাশ পাচ্ছে, সেগুলো আমাদের স্তম্ভিত করে। কেননা, মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের পক্ষে গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টিকারী সেসব প্রতারণামূলক তৎপরতা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। যাঁরা এসব অপরাধে লিপ্ত থেকেছেন, তাঁরা কোভিড–১৯ রোগী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদানের অনুমোদন পেয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই।

রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির জালিয়াতি, তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি স্বাক্ষর—এসব ন্যক্কারজনক কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব কেউ নেয়নি। এ মহামারিকালে স্বাস্থ্য খাতে যেসব গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে, এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পরিবর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে চলছে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে খবর বেরিয়েছে, শুধু রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ার নয়; স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কোভিড–১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল, যাদের কারোরই তা করার প্রস্তুতি ছিল না। অনুমতি পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোও নমুনা পরীক্ষা না করেই করোনার ভুয়া সনদ দিয়ে আসছিল। এটা জানার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের অনুমোদন বাতিল করেছে। এ সময়ের মধ্যে তাদের ভুয়া করোনার সনদ দেওয়ার ফলে কত মানুষের সর্বনাশ ঘটেছে, তা বলা কঠিন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার প্রস্তুতি ও সার্বিক সক্ষমতা যাচাই করার পর তাদের পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া। শুধু তাই নয়, অনুমোদন দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে পরীক্ষা করে সঠিক রিপোর্ট দিচ্ছে কি না, তা নিয়মিত মনিটর করা। কিন্তু মনিটর করা দূরে থাক, অনুমোদন দেওয়ার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানগুলো সরেজমিন পরিদর্শন পর্যন্ত করেনি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তাদের পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল? এ ক্ষেত্রে কোনো অনৈতিক যোগসাজশ, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব ছিল কি না?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন দায়িত্বহীন আচরণের একটা সম্ভাব্য ফল দৃশ্যমান: যে পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তারা কোভিড–১৯ পরীক্ষার অনুমতি দিয়ে পরে জালিয়াতির দায়ে অনুমতি বাতিল করেছে, তাদের মধ্যে একটি গুলশানের সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শুধু করোনা পরীক্ষার অনুমোদন পেয়েই করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষাও করাচ্ছিল, যা পরীক্ষার অনুমোদন তাদের দেওয়া হয়নি। এমন অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাব হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে একজন সহকারী পরিচালক ও একজন কর্মকর্তাকে আটক করেছে। বলা বাহুল্য, জালিয়াতিপ্রবণ এ ধরনের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এমন দুঃসাহসের উৎস সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর দায়িত্ব পালনে শিথিলতা কিংবা অনৈতিক প্রশ্রয়।

রিজেন্ট-জেকেজি থেকে শুরু করে উল্লিখিত পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালের জালিয়াতিসহ কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় গত প্রায় সাড়ে চার মাসে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও সার্বিক অব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পারস্পরিক দোষারোপে কোনো ফল ফলবে না। উভয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা জরুরি। সে জন্য সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ প্রয়োজন।