বর্ষায় অপরূপ ভাঙন-বাণিজ্য

সেতু আছে কিন্তু সড়ক ভেসে গেছে। ফাইল ফটো: প্রথম আলো
সেতু আছে কিন্তু সড়ক ভেসে গেছে। ফাইল ফটো: প্রথম আলো

বর্ষার আশায় অনেকে প্রহর গোনে। ভালো বর্ষা, ভালো ফসল, ভালো ভবিষ্যৎ। এটা কৃষকের অভাবের মাস। খুদকুড়া খেয়ে কাটিয়ে দেওয়ার সময়। আগামীর আশায় সহ্য করার সময়। তবে অন্য একদল বর্ষায় ‘দাঁও মারার’ অপেক্ষায় থাকে। বর্ষা মানেই নতুন নতুন প্রকল্পের জন্ম—নতুন নতুন মেরামতির বাজেট। জালিয়াতি–প্রতারণার চিহ্ন ধুয়ে দেওয়ার জন্য বন্যা, বর্ষা ও নদীভাঙনকে তারা ব্যবহার করে। তাই এ রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তারা খুশিই হয়।

প্রতি বন্যায় বাঁধ ভাঙে, আমরা বাঁধের মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমালোচনায় মাতি। এবারও ভোগাই নদের বাঁধ প্রথম ধাক্কাতেই ছুটে গেছে। চিত্রনাট্য অনুযায়ী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। যথারীতি তাঁরা হতভাগ্য মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন ‘দ্রুততম’ সময়ের মধ্যে ভোগাই নদের বাঁধ পুনর্নির্মাণের। ১২ জুলাই শেরপুরের নালিতাবাড়ীর উপজেলার মরিচপুরান ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের কাছে এই বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার ভেঙে গেলে প্রবল বেগে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে যায় আশপাশের কয়েকটি গ্রামে। মরিচপুরান, খলাভাঙ্গা, কোন্নগর ও ফকিরপাড়া এলাকার হাজার হাজার পরিবার এখন পানিবন্দী। তলিয়ে গেছে ওই এলাকার আমনের বীজতলাসহ ফসলি জমি। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ।

এসব নিয়ে চাষিরা চিন্তিত কিন্তু হতাশ নন। তাঁদের কপালে ভাঁজ পড়েছে অন্য কারণে। মৃগী, মহারসী, ভোগাই, চেল্লাখালী ও সোমেশ্বরী নদীতে বান ডাকলে আর দুকূল উপচিয়ে বা বাঁধ ভেঙে কৃষিজমি, ভিটাবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেলে পানির সঙ্গে বালু পড়ে নষ্ট হয়ে যায় আবাদি জমি। তাই বাঁধ ভাঙলে কৃষকের শুধু বর্তমান যায় না ভবিষ্যৎও ভেস্তে যায়। তাই জাতীয়ভাবে কম পরিচিত বাঁধগুলোর গুরুত্ব অন্য রকম। সিরাজগঞ্জ বা চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের মতোই অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এসব বাঁধের ভূমিকা।

দাঁও মারার সুযোগ আগামী দিনগুলোয় আরও হবে। ১৬ জুলাই গভীর রাতে ফরিদপুরের বাঁধ ভেঙে ফরিদপুর শহরের বর্ধিত পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে ভাজনডাঙ্গা মহল্লা তলিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচিতে শুনে মানুষ জেগে দেখে, পানিতে ডুবে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। সমতলের ধীর বন্যা জলোচ্ছ্বাসের রূপ নেয় দায়িত্ববানদের গাফিলতিতে।

বন্যা শুধু নতুন বাঁধের আর মেরামতির ঠিকাদারি সুখবর দেয় না; নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত নানা মন্ত্রণালয় আর বিভাগের ভাগ্যের চাকাও ঘুরিয়ে দেয়। যেমন মাত্র দুমাস আগে নির্মিত নাটোরের সিংড়া-তেমুক-নওগাঁ সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যোগাযোগব্যবস্থা। দু–তিন জায়গায় রাস্তার কোনো চিহ্ন নেই। রাস্তা ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর-বাগান-খেত। তাও আটাশির বন্যা হলে কথা ছিল। এটা তো মধ্যম আয়ের দেশের মাঝারি গোছের বন্যা। দুই মাস আগেই প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রাস্তা ভেঙে যাওয়ার জন্য দোষ দিয়েছে আত্রাই নদকে—তার পানির তোড় নাকি বেশি ছিল। সিংড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, সড়কের নির্মাণকাজে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কে দেখছেন, কেমন করে দেখছেন, কবে সেটা জানা যাবে, তা আল্লাহ মালুম। তবে জনতাকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ‘দুর্নীতির প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ শুধু বলেননি ‘সে যে দলেরই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে।’ তবু ভরসা রাখতে হবে।

১৭ জুলাই চাঁদপুরে রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চবিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। তিনতলা ভবনটি মাত্র এক মাস আগে নির্মাণ সম্পন্ন করে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লকডাউনের মধ্যে এই তাড়াহুড়ো হস্তান্তর নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল। ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত এই ভবন এখন খাতায় থাকবে, গোয়ালে নয়। ঠিকাদার কোম্পানির ‘স্থানীয় প্রতিনিধি’ ছিলেন একজন করিতকর্মা ইউপি সদস্য। ভুঁইফোড় চাঁদাবাজ আর সাধারণ মানুষের সতর্ক দৃষ্টি সামলানোর জন্য আজকাল শক্তিশালী স্থানীয় প্রতিনিধি বা এজেন্ট রাখার চল হয়েছে। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওমর আলী উচ্চবিদ্যালয়টি সাত থেকে আটবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, ওই এলাকা খুবই ভাঙনপ্রবণ। প্রথম কথা হচ্ছে, ভাঙনপ্রবণ এলাকায় এই ইমারত কি তবে জেনেশুনেই তৈরি করা হয়েছিল? চাঁদপুর কি জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকা? সেখানে গত ৪০ বছরে কত মানুষ জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছে যে সেখানে বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার বানাতে হবে? কে কার কাছে করবে এসব প্রশ্ন? কী হবে এসবের জবাব?

মাদারীপুরের শিবচরে নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে দ্বিতল প্রাথমিক স্কুল ভবনসহ দুটি ইউনিয়নের দুটি স্কুল। ১৫ দিনের ব্যবধানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ তিনটি স্কুল চলে গেছে নদীতে। ভাঙনের ঝুঁকিতে ছিল হাটবাজার ইউনিয়ন পরিষদ ভূমি অফিস, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

চাঁদপুরের ইমারত হস্তান্তর দেখিয়ে খেল খতম পয়সা হজম সম্ভব হলেও কুড়িগ্রামের মানুষ বছর কয়েক আগে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। চিলমারী উপজেলার অষ্টমীরচর ইউনিয়নে নদীর কোল ঘেঁষেই নটারকান্দি উচ্চবিদ্যালয়ের পাকা ভবন তৈরি করা হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন বিদ্যালয়টি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন, নদীর এত কাছে বিদ্যালয়টি টিকবে না। ভাঙন শুরু হলে সব নদীর পেটে চলে যাবে। অভিযোগ ছিল বদলি ঠিকাদার বিদ্যালয়টি যেকোনো সময় নদীগর্ভে যাবে জেনেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের নিযুক্ত ওই ব্যক্তি প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিম্নমানের ইট, বালু, সিমেন্ট ও রড ব্যবহার করে যেনতেনভাবে নির্মাণকাজ শেষ করেন। এরপর শুরু হয় হস্তান্তরের চাপ। স্থানীয় জনগণ এবং প্রধান শিক্ষক রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আর হস্তান্তরিত হয়নি। ফলে ভাঙারিদের কাছে নিলামও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঠিকাদার ঠিকই টাকা নিয়ে গেছেন।

ভাঙনপ্রবণ এলাকায় জেনেশুনে পাকা ইমারত তৈরি করে বছর না ঘুরতেই তা ভাঙারিদের কাছে নিলাম করার ঘটনার তালিকা দিলে ফুরাবে না। আগে নিয়ম ছিল চর বা ভাঙনপ্রবণ এলাকায় স্কুলবাড়ি হবে বাঁশ-কাঠ-টিনের। যাতে ভাঙন হলে মানুষ সেটা খুলে নতুন জায়গায় আবার বসাতে পারে। ভাঙনপ্রবণ এলাকার এটাই চর্চা। ভাঙনে গ্রাম ভাঙে কিন্তু সমাজ ভাঙে না। সবাই মিলেই পুনর্বাসিত হয় নতুন জায়গায়। বসতঘরের সঙ্গে সঙ্গে বয়ে নিয়ে যায় মসজিদঘর আর স্কুলবাড়ির টিন, বাটাম, খুঁটি। পাকা ইমারতের পুরাটাই যায় ঠিকাদারের পেটে। ধ্বংস হয় সমাজ, ভাঙতে না দেওয়ার সামাজিক অঙ্গীকার ভেসে যায়। ভেসে যায় আমাদের সবেধন নীলমণি সামাজিক মূলধন। দেশটা কবে সমাজের হবে? গরিবের হবে?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]