তাজউদ্দীন আহমদ: দুর্দিনে স্বপ্নের কান্ডারি

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। তাঁর সমন্ধে আজকের প্রজন্ম খুব কমই জানে। এটা তাদের দোষ নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, কারিকুলাম, গবেষণা, আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে তাঁকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। জাতীয় জাদুঘর-মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরগুলো থেকেও তাঁর সম্বন্ধে জানা যাবে খুব কম। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে ভালোমতো জানা ছাড়া আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও সঠিক জানতে পারব না।

তাজউদ্দীন আহমদ, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, শীতলক্ষ্যা নদীতীরবর্তী, লাল মাটির আলপনায় আঁকা, শাল-গজারি বনের বেষ্টনীতে ঘেরা শ্যামল সবুজ দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরবর্তী এই গ্রামে যে প্রতিভাবান শিশুটি সেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর হাতেই যে একটি রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হবে, কে জানত? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রেরণা, যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, তখন তাঁর অবর্তমানে সর্বসম্মতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর।

স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে সরকারের নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন, তার পটভূমি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পালিয়ে যাবার পথে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতালাভের চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেবার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হোল, একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।’

যুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রীর পদটি তাঁর জন্য কোনো ফুলশয্যা ছিল না। তাঁকে প্রতিহত করতে হয়েছিল দলের ভেতরের খন্দকার মোশতাক চক্র এবং আরও কারও কারও স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ সরকারবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। তাঁকে সে সময় হত্যার প্রচেষ্টাও নেওয়া হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রগুলো প্রতিহত করে, এক কোটি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার ভরণপোষণ, অস্ত্র-রসদের ব্যবস্থাসহ সেই যুদ্ধকালে যেসব অভূতপূর্ব জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার মোকাবিলা করে তিনি যেভাবে সংকট উত্তরণ করেছিলেন; সেই বিষয়গুলো আজকের প্রজন্মকে জানাতে হবে।

তিনি দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সমঝোতাভিত্তিক পাকিস্তানকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত কনফেডারেশন গঠনের পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন। সিআইএর নথিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের জন্য আপসহীন এবং পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে। বাংলাদেশের গণহত্যা পরিকল্পনার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো তাজউদ্দীনের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার এ বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন অনেক আগেই। একাত্তরের মার্চ মাসে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালীন তিনি বলেছিলেন যে একদিন তাজউদ্দীন হবেন তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাজউদ্দীন আহমদ সত্যিই পাকিস্তান ও তার দোসরদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তিনি তাঁর বৈশ্বিক-কূটনৈতিক জ্ঞানের সম্ভারকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যুক্ত করে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করেন।

কূটনৈতিক ফ্রন্টে যুদ্ধের বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তেমনি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল আমাদের। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করার লক্ষ্য ছিল নভেম্বর মাস। কেননা আমি জানতাম বাংলাদেশে বর্ষাকালে পানি নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাস্ত না করতে পারলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ সফলকাম হবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও আসবে না। এ ছাড়া আরও বুঝেছিলাম যে ওই সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে না যাওয়া হলে মার্কিনিরা তার সুযোগ নেবে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধকে নিয়ে আসবে বাংলার মাটিতে। কেননা আমেরিকাকে ভিয়েতনাম থেকে সরতেই হবে। আর এ সম্পর্কে আমরা খুবই হুঁশিয়ার ছিলাম।’

ভারতের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এমনকি যুদ্ধের দিনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনই হবে, যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না।’

৬ ডিসেম্বর ভারত যেদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দিল, দেশ–বিদেশের সাংবাদিকেরা তাঁর মনোভাব জানার জন্য তাঁকে যখন ঘিরে ধরেছেন, তিনি তখন অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে আপনারা এসেছেন আমার অনুভূতি জানার জন্য? যে শিশুর জন্মগ্রহণ হলো, সেই শিশুর খবর আমি তাঁর পিতার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমি ধাত্রীর কাজ করেছি।’ রামের অবর্তমানে ভরত যেমন রামের পাদুকা সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য শাসন করেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতাযুদ্ধকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামেই। বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর তিনি নামকরণ করেছিলেন, ‘মুজিবনগর’। মুক্তিযুদ্ধকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য পাকিস্তানের হয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা এই প্রচার চালিয়েছিল যে ‘স্বাধীনতা চাও না মুজিবকে চাও। যদি স্বাধীনতা পেতে হয়, তাহলে মুজিবকে পাবে না। আর মুজিবকে পেতে হলে স্বাধীনতাসংগ্রামকে বিসর্জন দিতে হবে।’ তাজউদ্দীন এর জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা চাই এবং মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই আমরা মুজিবকে ফিরে পেতে পারি।’ হলোও তা–ই, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন।

আত্মপ্রচারবিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল বাংলাদেশের মঙ্গল ও অগ্রগতি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে গড়ার জন্য তিনি অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সমাজকল্যাণ-স্বাস্থ্য-পুনর্বাসন প্রভৃতি শাখা ও পরিকল্পনা সেল তৈরি করেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে না পাঠিয়ে তাঁদের টগবগে উদ্দীপনা ও ত্যাগকে দেশ গড়ার কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের। দুর্ভাগ্য যে তাঁর সব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। অন্যদের ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য পায়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি যেমন তার নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসে সম্ভবপর হয়েছিল, তেমনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকেও তিনি গড়তে পারতেন সারা বিশ্বের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে। কিন্তু সেই সময় আর সুযোগ তিনি পাননি। বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিন ১০ এপ্রিলের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্যে আমরা যে মূল্য দিয়েছি, তা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্য নয়।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন একটি সবল ও স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য, যাকে অন্য কোনো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে না। তিনি গণমানুষের কল্যাণে যে তিনটি বাজেট নিজ হাতে প্রণয়ন করেছিলেন, তা আজও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বাজেট রূপে পরিগণিত।

তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর অর্ধশতাব্দীর জীবনে যে অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন, তা বাংলাদেশের স্বার্থেই জানা জরুরি। তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে যে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে স্বাধীনতার অঙ্গীকার সাম্য, সুবিচার ও মানবিক মর্যাদার আলোকিত পথে। তাঁর জন্মদিনে এই প্রার্থনা রইল।

তথ্যসূত্র:
তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে। সম্পাদনা সিমিন হোসেন রিমি। ঢাকা, প্রতিভাস, বৈশাখ ১৪০৭
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার, তাজউদ্দীন আহমদ নিঃসঙ্গ সারথি। ডকুমেন্টারি পরিচালনা: তানভীর মোকাম্মেল: প্রযোজনা: সিমিন হোসেন রিমি। https://www.youtube.com/watch?v=D9SrLyfYJ-Q
মূলধারা ৭১। মঈদুল হাসান।ঢাকা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৬
তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা। শারমিন আহমদ। ঢাকা, ঐতিহ্য, ২০১৪

*শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা