পিঁপড়া যাবে না, হাতি যেতে পারে

আমি মাত্র গত পরশুই টেলিভিশনে হিস্ট্রি চ্যানেলে একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখছিলাম। পেরুর লিমার বিমানবন্দরে নিরাপত্তা তল্লাশি এর বিষয়। কেমন করে বিমানবন্দর দিয়ে হেরোইন পাচার করা হয় আর কীভাবে নিরাপত্তাকর্মীরা তা ধরে ফেলেন। মোটা মোটা জ্যাকেট স্যুটকেসের ভেতরে। জ্যাকেট কেটে দেখা গেল, ভেতরের একটা কাপড়ের সঙ্গে হেরোইন আঠা দিয়ে আটকে রাখা আছে। এই রকম অনেকগুলো স্যুটকেসের জ্যাকেট আটকানো হলো।

নিরাপত্তাকর্মীদের কাজই হলো সন্দেহ করা। তল্লাশি করা। এক মহিলা তিন প্যাকেট কফি নিয়ে যাচ্ছেন লিমা থেকে প্যারিসে। তাঁর কফির প্যাকেট কেটে কফি টেস্ট করা হলো কোকেন আছে কি না। একটা কান চুলকানোর কাঠির মতো (ইয়ার বাড) কফিতে ধরা হলো। কোকেন থাকলে ওই সাদা কাঠি রং পাল্টাবে। না, কিছু পাওয়া গেল না।

এরপর গতকালই একটা কৌতুক পেলাম ফেসবুকের ইনবক্সে: বল্টু রোজ সাইকেলের পেছনে বস্তা নিয়ে নিরাপত্তাচৌকি পার হয়। রক্ষী তাকে আটকায়। ‘তোমার বস্তায় কী?’

‘বালি, স্যার।’

‘তুমি বালি নিয়ে যাচ্ছ?’

‘জি স্যার।’

‘তোমার বস্তা তল্লাশি করব।’

‘করেন স্যার।’

রক্ষী ভালো করে বস্তা পরখ করল। বালু টিপে টিপে দেখল। না, সত্যিই বালু।

এর কদিন পর আবার বল্টু যাচ্ছে সাইকেলে বস্তা নিয়ে।

‘তোমার বস্তায় কী?’

‘বালি, স্যার।’

রক্ষী ভালো করে বস্তা পরীক্ষা করে ছেড়ে দিল বল্টুকে।

দুদিন পর আবারও বল্টু রাস্তায়, সাইকেলে নিয়ে যাচ্ছে বস্তা।

‘তোমার বস্তায় কী?’

‘বালি, স্যার।’

‘না। আজ তোমার বস্তার বালি আমি কেমিক্যাল টেস্ট করব।’

‘করেন স্যার। বালি ছাড়া আর কিছু পাবেন না।’

বালু টেস্ট করা হবে। বালু পানিতে ধুয়ে সেই পানি পাঠানো হলো ল্যাবে। বালুও পাঠানো হলো। দুদিন পরে রিপোর্ট এল: বস্তায় বালু ছাড়া আর কিছু নেই।

চতুর্থবার বল্টু সাইকেলে বালুর বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। রক্ষী বলল, ‘বল্টু, তুমি বালির বস্তা নিয়ে যাও, এটা হতে পারে না। সত্যি করে বলো, আসলে তুমি কী নিয়ে যাও। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে ছেড়ে দেব।’ বল্টু বলল, ‘স্যার, আমি সাইকেল চোরাচালান করি।’

ফেসবুকের মেসেঞ্জারে এই কৌতুকের নিচে বলা হয়েছে: সাহেদ, সাবরিনা, পাপিয়া, সম্রাট—এঁরা সবাই বস্তার বালি। সাইকেলগুলো কই?

আমার মনে অন্য শঙ্কাও কাজ করে। আজকে কোভিড–১৯ মহামারি এসেছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর আর স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমরা কথা বলছি। এই ক্ষেত্রটা যে দিনের পর দিন ধরেই চরম অমনোযোগ, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা, অঙ্গীকারহীনতার শিকার, তা আমরা এত দিন দেখতে পাইনি। শুধু একবার পর্দার বিল লক্ষাধিক টাকা দেখানোয় আমরা কিছু গোস্‌সা আর প্রচুর রগড় করেছিলাম। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রগুলোর কী অবস্থা? আমরা কি ঠগ বাছতে যাব! গাঁ উজাড় হয়ে যাবে না তো?

আমরা না শুনেছিলাম নির্বাচনপূর্ব এক অঙ্গীকার—দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’? এখন জিরো টলারেন্স নিজেই জিরো হয়ে গেল!

যাক। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছিলেন, করোনাভাইরাস কিছু না, ধাপ্পাবাজি। তারপর তিনি হাতে ওষুধ ধরে বলেছিলেন, এই ওষুধ খেতে হবে, তাহলেই করোনাভাইরাস আর কাবু করতে পারবে না। তিনি বলেছিলেন, মাস্ক পরতে হবে না। এটা কৌতুক নয়, সিরিয়াস। এপ্রিলের পর তিনি প্রথম এলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলতে বললেন, কোভিড–১৯ মহামারি ভালো হবে, তবে তার আগে এটা আরও খারাপ হবে। ১ লাখ ৪০ হাজার আমেরিকানের মৃত্যুর পর তিনি এ কথা বললেন।

দুনিয়াটার হলোটা কী? ট্রাম্প কেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট? আর তিনি যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্টই হবেন, এত উল্টাপাল্টা কথা কেন বলেন? নিউইয়র্ক টাইমস ২২ জুলাই লিখেছে, ট্রাম্প বলেছেন, ‘It will probably, unfortunately, get worse before it gets better।’ তিনি বলেছেন, ‘কই, আমি কখনো মাস্ক পরার বিরুদ্ধে বলিনি তো।’ (নিউইয়র্ক টাইমস–এর বক্তব্য: তিনি অসত্য বলেছেন)।

একটা প্রবাদ আছে: সামনে দিয়ে পিঁপড়া যেতে পারে না, কিন্তু পেছন দিক দিয়ে হাতি গেলেও টের পায় না।

পিঁপড়া আর হাতি যে সমান, তা জানেন তো। কারণ, দুজনেরই শুঁড় আছে। কাজেই সামনে দিয়ে পিঁপড়া গেলে হাতি যাচ্ছে হাতি যাচ্ছে বলে যদি আমরা চিৎকার করে উঠি, খুব একটা ভুল কিন্তু করা হয় না। পিঁপড়া আর হাতি তো একই। উভয়েরই শুঁড় আছে।

আর পেছন দিকে হাতি গেলে আমরা বলব, পিঁপড়া যাচ্ছে, পিঁপড়া যাচ্ছে। তাতেও ভুল হবে না। কারণ, হাতি তো পিঁপড়াই। শুঁড় আছে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক