তাহলে সাংবাদিকতার প্রয়োজন কী

চলতি বছর বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভয় ও পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা’।

কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যঁারা সাংবাদিকতা করি, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না আমরা নির্ভয়ে সাংবাদিকতা করতে পারছি। আইনি ও আইনবহির্ভূত ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনেক দেশের সরকার করোনা মহামারির সময় আরও বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন আইন, বিধি ও ফরমান জারি করে বলেছে, এটি লেখা যাবে, এটি লেখা যাবে না। সত্যাসত্য নির্ধারণের মালিক যেন সরকার। সেখানে সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষের বিচার করার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ কখনো ছিল না, এখনো নেই। ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে যে নিবর্তনমূলক আইনটি জারি হয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি সেটি সাংবাদিক দলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ আইনটি জারি করার সময় সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, এ আইন দ্বারা সাংবাদিকদের দমন বা হয়রানি করা হবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক ও মানহানিকর প্রচার বন্ধ করতেই এ আইন চালু করা হয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে জারি হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক ছাড়াও আছেন লেখক, কার্টুনিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী। অভিযুক্ত ১১৪ জনকে মামলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজলও আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সরকারদলীয় একজন সাংসদ। মামলার পর শফিকুল তাঁর হাতিরপুলের বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। মাসখানেক পর তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল বেনাপোল সীমান্তে। বেনাপোল পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া তিনি ভারতে গিয়েছিলেন। তিনি যদি ভারতে পালিয়ে গিয়ে থাকেন, সেখানকার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার কথা। যে বিএসএফের জওয়ানদের দৃষ্টি এড়িয়ে সীমান্ত দিয়ে মাছিও যেতে পারে না, গুলিতে প্রাণ যায়, সেই সীমান্ত দিয়ে শফিকুল কী করে পার হলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। শফিকুল এখনো জেলে, দুই মাস ধরনা দিয়েও জামিন পাননি। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ও একজন প্রতিষ্ঠিত আলোকচিত্রী।

করোনা মহামারি চলার সময়ে ত্রাণসামগ্রী চুরি ও আত্মসাতের খবর প্রচার করেও অনেক সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার হয়েছেন। তাঁদের কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউ শফিকুলের মতো কারাগারে আটক আছেন। করোনাকালে টেলিফোনের কলচার্জ বাড়ানোর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে ১৫ বছরের এক স্কুলপড়ুয়া কিশোর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কিশোর সংশোধনাগারে। ছেলেটি ভুল স্বীকার করার পরও রেহাই পায়নি। একই আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। অভিযোগ, তাঁরা প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁদের জেলে ঢুকিয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে। দলানুগত উপাচার্যদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কী আশা করা যায়?

 পত্রিকায় দেখলাম, উল্লিখিত সাবেক মন্ত্রীর পুত্রবধূ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তাঁর বাবার সম্পর্কে যাঁরা বিরূপ মন্তব্য করেছেন, তাঁদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এমনই মহিমা যে মামলা হলেই কারাবাস। আগে তাঁকে জেলে যেতে হবে, পরে নির্ধারিত হবে, তিনি অপরাধী না নির্দোষ। কোনো মামলা নিষ্পত্তি হতে পাঁচ বছর লাগলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঁচ বছরই জেলে থাকতে হবে।

এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে। তিনি সাড়ে তিন মাস জেল খেটেছেন। সম্প্রতি তিনি কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) প্রবর্তিত ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। অন্তত এ পুরস্কারের কৃতিত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দাবি করতে পারে।

সরকারের মন্ত্রীরা জোর গলায় প্রচার করে থাকেন যে দেশে গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা আছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছিলেন, মূলধারার সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশনগুলো করোনা–সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিচ্ছে বলে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসত্য সংবাদ বিশ্বাস করছে না। কিন্তু মূলধারার সেই সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল যখন সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে থাকল, তখন নীতিনির্ধারকেরা ভিন্ন সুরে কথা বলতে থাকলেন। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন। করোনার চিকিৎসাসেবা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও আইইডিসিআরের দুই রকম তথ্য সম্পর্কে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে পরদিন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করার সুযোগটি রহিত করে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অলিখিত নির্দেশ আছে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানেই।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২০ সালে মুক্ত সাংবাদিকতায় আরও এক ধাপ পিছিয়ে গেছে। ৩ মে মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এমনকি পাকিস্তান (১৪৫) ও আফগানিস্তানের অবস্থানও আমাদের ওপরে (১২২)। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অবস্থান যথাক্রমে ১৪২, ১২৭ ও ১১২।

আর ৬৭ নম্বর পেয়ে ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে আছে। এরপর মালদ্বীপ ৭৯তম অবস্থানে। অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে আমরা এগিয়ে থাকলেও মুক্ত সাংবাদিকতায় পিছিয়ে আছি। এটি কেবল দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও।

সবার সামনে যে ঘটনা ঘটে, যে তথ্য মানুষের কাছে আপনা–আপনি এসে যায়, সেই তথ্য মানুষ গণমাধ্যমের কাছে পেতে চায় না। তারা সেই তথ্য পেতে চায়, যা কর্তৃপক্ষ (কর্তৃপক্ষ মানে সব সময় সরকার নয়, সরকারের বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে) আড়াল করতে চায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই আড়াল থেকে তথ্য খুঁজে বের করা কঠিন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেটিকে আরও কঠিনতর করে দিয়েছে।

যে দেশে এ রকম নিবর্তনমূলক আইন থাকে, সে দেশে ভয় ও পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। সাংবাদিকদের সব সময় ভয় সঙ্গে করেই চলতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সরকারের একতরফা ভাষ্য প্রকাশ ও প্রচার করতে বাধ্য হন। এর বিপরীত যে বয়ান আছে, সেটি প্রচার করতে পারেন না। সম্প্রতি এবং নিকট অতীতে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। আবার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য ও ব্যাখ্যা চেয়েও পাওয়া যায় না। সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী তার বক্তব্যটা পাওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রেও সাংবাদিককে সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে হয়। এ অক্ষমতা স্বীকার করতেই হবে।

 অন্যদিকে সরকারও বলার সুযোগ পাচ্ছে দুর্নীতি-অপকর্ম তো আমরাই ধরছি। হ্যাঁ, তারা যেটুকু ধরছে, সেটুকুই জনগণ জানবে, আর বাকিটা আড়ালেই থেকে যাবে।

তাহলে সাংবাদিকতার প্রয়োজন কী?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]