সংক্রমণের উদ্বেগজনক লক্ষণ

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ প্রকটতর হচ্ছে। এ রোগ প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকায়। তারপর নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ রাজধানীর আশপাশের কিছু এলাকায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কোভিড–১৯ ঢাকার বাইরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে এখন প্রতি চারজনের নমুনা পরীক্ষা করে একজন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এই হিসাবে সংক্রমণের হার দাঁড়াচ্ছে শতকরা ২৫ ভাগ। অর্থাৎ ঢাকার বাইরের গড় সংক্রমণ হার ঢাকা ও এর আশপাশের সংক্রমণের হারের চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। ঢাকা ও এর আশপাশে এখন সংক্রমণের হার ২০-২১ শতাংশ। ঢাকার বাইরে সংক্রমণের হার বৃদ্ধির এ তথ্য যারপরনাই উদ্বেগজনক। কারণ, এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি কমিউনিটি ইনফেকশন বা সামাজিক সংক্রমণ হিসেবে দেশব্যাপী রূপ ধারণ করেছে। শুধু রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই।

সংক্রমণ প্রবণতার এ উদ্বেগজনক ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে মোট সংক্রমিত রোগীর প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। আর বাকি ৩০ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরে সারা দেশে। কিন্তু এখন মোট সংক্রমিত রোগীর হার ঢাকার বাইরে বেড়ে গিয়ে ৪৯ শতাংশে উঠেছে এবং সংক্রমণ বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে শুক্রবার দুপুরে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই ঢাকার বাইরের।

আমরা উদ্বিগ্ন আরও এ কারণে যে সরকারি এ হিসাব থেকে ঢাকার বাইরে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সারা দেশে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালানোর আয়োজন এখন পর্যন্ত অত্যন্ত অপ্রতুল। ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে পরীক্ষা হচ্ছে অনেক কম। বর্তমানে সারা দেশে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষাকেন্দ্রের মোট সংখ্যা ৮০। এগুলোর মধ্যে ৪৬টিই ঢাকায় অবস্থিত। ঢাকার বাইরে সারা দেশে রয়েছে মাত্র ৩৪টি। এটি একটি বিস্ময়কর বাস্তবতা যে দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার সাড়ে চার মাস পরও ৪২টি জেলায় করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি। অথচ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকে তাগিদ দিয়ে আসছেন, ঢাকার বাইরে রোগী শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি, নইলে মহামারির প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে না। সংবাদমাধ্যমেও ঢাকার বাইরে পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে অনেক লেখা ছাপা হয়েছে; প্রথম আলোর একাধিক সম্পাদকীয় নিবন্ধেও এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এসব চাপেই সম্ভবত গত ১৮ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে করোনা শনাক্তের জন্য আরটিপিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে। তারপর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু দেশের ৪২টি জেলায় এখনো কোনো পরীক্ষাকেন্দ্র নেই।

পরীক্ষাকেন্দ্রের অভাবে রোগী শনাক্তকরণ সম্ভব না হলে সরকারি পরিসংখ্যানে রোগীর সংখ্যা কম দেখাবে বটে, কিন্তু তাতে মহামারি মোকাবিলায় সরকারের সাফল্য প্রমাণিত হবে না, বরং বিপদ আরও বাড়বে। কারণ, শনাক্ত তালিকার বাইরে থেকে যাবে অজস্র রোগী। এর মধ্যে উপসর্গহীন রোগীরা জনপরিসরে ঘুরে বেড়াবেন এবং তঁাদের সংস্পর্শে আরও অনেক মানুষ সংক্রমিত হবেন। এভাবে একপর্যায়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সুতরাং ৪২টি জেলায় দ্রুত পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে করোনা রোগীদের আইসোলেশন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আরও ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। ঈদুল আজহার সময় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক প্রচেষ্টাও জোরদার করা দরকার।