আমরা সব সক্ষমতাকে এক করতে পারছি না

অধ্যাপক সেলিম মমতাজ।
অধ্যাপক সেলিম মমতাজ।
>

বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবার বন্যার কবলে পড়েছে। বাংলাদেশের এ বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এবারের বন্যার নানা দিক, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে এই সাক্ষাৎকার ছাপা হলো। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসলের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম মমতাজের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ 

প্রথম আলো: বন্যা তো শুধু বাংলাদেশেই হয় না, উন্নত–অনুন্নত সব দেশে হয়। আমাদের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বন্যা ব্যবস্থাপনার পার্থক্য যদি বলতেন।

সেলিম মমতাজ: যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বন্যা হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। প্রথমত, প্রাকৃতিক কারণের বাইরেও বন্যা বেড়ে যাওয়ার কিছু মনুষ্যসৃষ্ট কারণ আছে। সেগুলো হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক চলার পথে বাধা সৃষ্টি করা। এসব দেশে এ ধরনের বাধা দূর করতে শক্ত আইন আছে এবং তা বাস্তবায়নের একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা আছে। বন্যার মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলার প্রশিক্ষিত জনবল আছে আর পরিস্থিতি সামলানোর মতো যথেষ্ট সম্পদ আছে। যেমন ধরেন অস্ট্রেলিয়ায় বুশ ফায়ার হলো, সেখানে কিন্তু আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রয়োজনীয় উদ্ধার যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হয়েছেন। সরকার থেকে ও সাধারণ মানুষেরাও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সরকার সেই সুযোগ করে দিয়েছে।

প্রথম আলো: আমরা ঠিক কোথায় পিছিয়ে?

সেলিম মমতাজ: আমাদের এখানে তো দুর্যোগ, পরিবেশসহ নানা বিষয়ে প্রচুর আইন আছে। সম্পদেরও অভাব নেই বলে শুনি, স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। কিন্তু তারপরও আমরা বন্যার মোকাবিলার ক্ষেত্রে এত সমস্যা দেখি কেন। সেই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। আমরা আমাদের সব সক্ষমতাকে একত্র করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আছে।

প্রথম আলো: সরকার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করছে, মানুষকে খাবার দিচ্ছে। কিন্তু বন্যার্তরা সেই সুযোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।

সেলিম মমতাজ: বন্যার্তদের ওপরে এ ক্ষেত্রে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছি। সেখানে দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনা প্রকট। বিশেষ করে সেখানে একদম উপায়হীন মানুষ ছাড়া যেতে চায় না। কারণ, সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধার যথেষ্ট অভাব আছে। যেমন বেশির ভাগ নারী রাতের আগে শৌচাগারেই যাওয়ার সুযোগ পায় না। সেগুলো পুরুষেরা দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করে, প্রচণ্ড নোংরা থাকে। আবার বেশির ভাগ নারী বাড়িতে সম্পদ চুরি হওয়ার ভয়ে বেশি দূরে যেতে চায় না। তার মানে আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।

প্রথম আলো: কিন্তু অনেকে তো মনে করেন, বড় আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণাই ঠিক নয়। প্রতিটি এলাকায় কয়েকটি বাড়িকে আশ্রয়কেন্দ্রের মতো উঁচু ও পাকা করে নির্মাণ করলে বাকি সময় সেখানে মানুষের সামাজিক কাজে ব্যবহৃত হবে। বন্যার সময় মানুষ সেখানে আশ্রয় নেবে।

সেলিম মমতাজ: হ্যাঁ, সেটাও হতে পারে। কারণ, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দূরে, এটাও মানুষের না যাওয়ার একটি কারণ। কাছে হলে সে তার বাড়ি ও সম্পদের খোঁজ নিতে পারবে। চীনে এ ধরনের এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি সেন্টার আছে। সেগুলো ঠিকমতো কাজ করেছে।

প্রথম আলো: করোনা ও বন্যা একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে চলবে। দুটি একসঙ্গে মোকাবিলার উপায় কী?

সেলিম মমতাজ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বন্যার সময় অন্য সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলার ব্যাপারে তারা অনেক আগে থেকেই একটি গাইডলাইন দিয়েছে। কিন্তু বন্যা ও করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো গাইডলাইন দেয়নি তারা। বাংলাদেশের মতো ব্রাজিল ও চীনেও কিন্তু করোনা ও বন্যা একই সঙ্গে চলছে। সেখানে তারা মাস্ক ও পিপিই পরে উদ্ধারকাজ করছে। আর যারা এগুলো করছে, তারা কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও রোগনিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষিত। আমাদের এখানে আমরা এটার ঘাটতি দেখছি।

প্রথম আলো: তাহলে আমরা এ বন্যা ও করোনা একসঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি?

সেলিম মমতাজ: অস্ট্রেলিয়ায় আমরা দেখেছি বুশ ফায়ারের সময় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে ব্যাপকভাবে দাঁড়িয়েছেন। খাবার থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য তাঁরা স্বপ্রণোদিতভাবে আক্রান্ত এলাকায় পাঠিয়েছেন। আমাদের এখানে বন্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারকে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে নিয়ে এগোতে হবে। সবার জন্য সবার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে। নয়তো সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সেলিম মমতাজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ড. সেলিম মমতাজ: অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসলের সহযোগী অধ্যাপক।