জাতীয় পার্টি ও হুকুমবরদার মহাসচিবগণ

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। ফাইল ছবি
জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। ফাইল ছবি

দেশে অনেকগুলো জাতীয় পার্টি আছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (এ) জাতীয় সংসদের স্বীকৃত বিরোধী দল। যদিও বিরোধী দলের অনেক সাংসদ তাঁদের নেতৃত্ব মানেন না। বিএনপি মনে করে, তারাই প্রকৃত বিরোধী দল। জাতীয় পার্টি সরকারের বি-টিম। বি-টিম প্রকৃত বিরোধী দল হতে পারে না। ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠনের পর সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোয় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সংসদে বিরোধী দল নির্ধারণ করার মালিক আওয়ামী লীগ নয়। অথচ আওয়ামী লীগই ঠিক করেছে কে বিরোধী দল হবে। কেননা, নির্বাচনটি তারা একসঙ্গে করেছে। প্রার্থী ভাগাভাগি করেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ যখন গঠিত হয়, তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ ছিলেন উপনেতা। এরপর এরশাদ বেঁচে থাকতেই ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে দলের ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান মনোনীত করে যান। গত বছর ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন ও কাদের দুজনই চেয়ারম্যান পদের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা কাদেরের পক্ষে অবস্থান নিলে রওশন পিছু হটেন। গত ডিসেম্বরে দলের কাউন্সিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তাঁকে চেয়ারম্যান করার বিষয়ে আরেক নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মুখ্য ভূমিকা ছিল। ওই কাউন্সিলে মহাসচিব পদে মসিউর রহমান রাঙ্গা পুনর্নির্বাচিত হলেও তাঁর অবস্থান যে নড়বড়ে, সেটি তখনই বোঝা গিয়েছিল।

ছয় মাসের ব্যবধানে তাঁকে সরে যেতে হলো। গত শনিবার জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এক সাংগঠনিক আদেশে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে পার্টির মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মহাসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গার স্থলাভিষিক্ত হবেন। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ / ১ (১) ক উপধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই আদেশ কার্যকর হবে।’ 

আপাতদৃষ্টিতে এই পরিবর্তনকে আকস্মিক মনে হলেও জাতীয় পার্টিতে টানাপোড়েন চলছিল অনেক আগে থেকে। সাবেক মহাসচিব রওশনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ করে এরশাদের শূন্য আসনে দলের চেয়ারম্যান চাইছিলেন না সাদ এরশাদ মনোনয়ন করুন। কিন্তু রওশন ও মসিউরের যৌথ চাপের কারণে তিনি তাঁকে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হন।

একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মসিউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে গত বছর নভেম্বর মাসে তিনি শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে এমন অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন, যা আওয়ামী লীগের পক্ষে হজম করা কঠিন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৮৭ সালে যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন নিহত হন। তাঁর বুকে-পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। জাতীয় পার্টির মহাসচিব তাঁর নেতা এরশাদের গুণকীর্তন করতে গিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেনকে ‘ফেনসিডিলখোর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর বক্তৃতায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। সংসদে এ নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ হলে তিনি ক্ষমা চান।

গত বছর নভেম্বরে সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের বিরুদ্ধে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করেন। মসিউর রহমান মালিক সমিতি ও শাজাহান খান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। এই ধর্মঘট নিয়েও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের ওপর বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। ডেইলি স্টার লিখেছে, সরকারকে খুশি করতেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আসতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই দুই নেতা দলে ভারতপন্থী হিসেবেও পরিচিত।

বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মহাসচিব পদে রদবদল জাতীয় পার্টিতে এটাই প্রথম নয়; ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় পার্টিতে সব মহাসচিবই একই কায়দায় এসেছেন এবং বিদায় নিয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ছিলেন ডা. আবদুল মতিন, যিনি জিয়া ও সাত্তারের সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তিন বছর পর মতিনকে সরিয়ে এ পদে আনা হয় অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানকে। এরপর আসেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। ১৯৯০ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র হলে এরশাদ তাঁকে সরিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে মহাসচিব করেন; তিনি নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় বিরোধী দলের পদত্যাগের দাবির জবাবে বলেছিলেন, ‘পদত্যাগপত্র কি জিরো পয়েন্টে দিয়ে আসা হবে?’

১৯৯২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শাহ মোয়াজ্জেম মহাসচিব ছিলেন। এরশাদ কারাবন্দী থাকা অবস্থায় প্রথমে চিরকুট পাঠিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে সরিয়ে খালেদুর রহমান টিটোকে এবং পরে তাঁকে বাদ দিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব পদে বসান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জাতীয় পার্টি তাতে যোগ দেয় এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী হন। এরশাদও কারামুক্ত হন। তবে সরকারে থাকা না-থাকা নিয়ে জাতীয় পার্টিতে তখন মতভেদ ছিল। একপর্যায়ে এরশাদ সরকারে না থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং মঞ্জুকে পদত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু মঞ্জু তাঁর সিদ্ধান্ত অমান্য করে আলাদা জাতীয় পার্টি করেন।

এরশাদের পরবর্তী মহাসচিব হন নাজিউর রহমান মঞ্জুর। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া প্রশ্নে দলে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব হন এ বি এম শাহজাহান। এর দুই বছর পর তাঁকে সরিয়ে মহাসচিব করা হয় রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তিনি ১২ বছর এই দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৪ সালে হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব করা হয়। কয়েক বছর পর বাবলুর স্থলে ফের আসেন রুহুল আমিন হাওলাদার। কিন্তু গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাঁকে সরে যেতে হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন মসিউর রহমান, যিনি গত রোববার পর্যন্ত বহাল ছিলেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তাঁর গায়ে স্বৈরাচারের ছাপ নেই। দলের নেতা-কর্মীরা আশা করেছিলেন, চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি গণতান্ত্রিক ধারায় দল চালাবেন। কিন্তু জাতীয় পার্টি এখনো চলছে এরশাদের ধারায়। গঠনতন্ত্রে সর্বময় ক্ষমতা চেয়ারম্যানকে দেওয়া হলে এ রকমই হবে। জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যানই একমাত্র নেতা। আর সবাই তাঁর হুকুমবরদার। জাতীয় পার্টির বিজ্ঞপ্তিটি লক্ষ করুন: চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমনভাবে, যেমন করে অফিসের প্রধান নির্বাহী অধস্তনদের নিয়োগ দেন। এখন নিয়োগ ও বিয়োগের রাজনীতিই চলছে দেশে। এই দায় জাতীয় পার্টির একার নয়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail.com