নিজের 'হাতের পাঁচ আঙুল' গোটাচ্ছে চীন

সারা দুনিয়া যখন কোভিড-১৯ মোকাবিলা করতে গিয়ে জেরবার হচ্ছে, তখন যে দেশে এ মহামারির উৎপত্তি হয়েছে, সেই চীন আধিপত্য বিস্তারের জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছে। হিমালয় থেকে হংকং এবং তিব্বত থেকে পূর্ব চীন সাগর—সবখানেই দেশটি এত আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে মনে হচ্ছে মাও সে তুং যেখানে এ আগ্রাসনের সমাপ্তি টেনেছিলেন, সেখান থেকে সি চিন পিং শুরু করেছেন।

তিনি নিজের দেশে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালান, নিবর্তনমূলক আইন পাস করে হংকংয়ের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছেন, উইঘুর মুসলমানদের ধরে আটককেন্দ্রগুলো ভরে ফেলেছেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য আইন পাস করে নিয়েছেন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েন বলেছেন, সি চিন পিং নিজেকে জোসেফ স্তালিনের উত্তরাধিকারী মনে করেন। অনেকে সি চিন পিংকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে ‘সিটলার’ নামে ডাকেন। তবে যাঁর সঙ্গে সি চিন পিংয়ের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় তিনি হলেন তাঁর পূর্বসূরি মাও সে তুং। 

প্রথমত, সি নিজের ব্যক্তিত্বকে মাওয়ের চরিত্রের আদলের সঙ্গে মিল রেখে প্রকাশ করছেন। ২০১৭ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) তাদের সংবিধানে নতুন রাজনৈতিক মতবাদ চালুর ঘোষণা দেয়। সংবিধানে বলা হয়, ‘সি চিন পিংয়ের সমাজতান্ত্রিক ভাবনা নতুন যুগের সঙ্গে তাল মেলানো এবং চীনের নিজস্ব চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’ নতুন যুগের সঙ্গে সংগতি রেখে চলা এ
নীতি সি চিন পিংকে চীনের আধুনিকায়নের জনক দেং জিয়াও পিংয়ের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সিপিসি গত ডিসেম্বরে সি চিন পিংকে ‘এনমিন লিংজিউ’ শীর্ষক একটি অভিধা দিয়েছে, যার অর্থ ‘জনগণের নেতা’। এ খেতাব এর আগে মাও সে তুংকে দেওয়া হয়েছিল। এখন তিনি মাওয়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার মিশনে নেমেছেন। 

মাও জিনজিয়াং, তিব্বতসহ কিছু এলাকা দখল করে দেশের ভূখণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ বানিয়েছিলেন। চীন এখন বিশ্বের চতুর্থ বড় দেশ। তিব্বত দখল করার পর চীনের সঙ্গে ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। মাও তিব্বতকে চীনের ডান হাতের তালু মনে করতেন আর সেই হাতের পাঁচটি আঙুল হিসেবে নেপাল, ভুটান, এবং ভারতের লাদাখ, সিকিম ও অরুণাচলকে মনে করতেন। 

১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন ভারতের কাছ থেকে লাদাখের একটি বড় অংশ ছিনিয়ে নেয়। এর আগেই সুইজারল্যান্ডের সমান ভূখণ্ডবিশিষ্ট আকসাই চীন দখল করে নেয়। গত এপ্রিল ও মে মাসে পিপলস লিবারেশন আর্মি সুপরিকল্পিতভাবে লাদাখে ঢুকে পড়ে ভারতের বিরাট অংশ দখল করে নেয়। এরপর সি চিন পিং লাদাখ, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশ–সংলগ্ন লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে (এলএসি) কয়েক লাখ সেনা মোতায়েন করে ফেলেন। এরপরই ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের সেনাদের সংঘর্ষ বাধে। সিপিসি তার অন্য দুটো আঙুল ভুটান ও নেপালের কথা ভুলে যায়নি। 

১৫ জুন সংঘাতের এলাকা থেকে ভারত ও চীন সেনা প্রত্যাহার যখন শুরু করল, তার মধ্যেই চীন ভুটানে তার বিস্তারবাদ কায়েম শুরু করল। ২০১৭ সালে চীন তিব্বত, সিকিম ও ভুটানের সংযোগস্থল দোকলাম এলাকা দখল করেছিল। ভারত ভুটানের কার্যত নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীন ভুটানের এ এলাকা ছিনিয়ে নেয়। এখন চীন আবার ভুটানের ১১ শতাংশ জায়গার মালিকানা দাবি করছে যে জায়গাটির সঙ্গে অরুণাচলের সীমান্ত যুক্ত রয়েছে। অরুণাচলের ওই জায়গা চীন অনেক আগে থেকেই দাবি করে আসছে এবং তাদের মানচিত্রেও জায়গাটি নিজেদের বলে উল্লেখ করেছে। চীনের পঞ্চম আঙুল নেপালকে রাজনৈতিকভাবে তারা দখল করেই ফেলেছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত চীনের নির্দেশেই নেওয়া হচ্ছে। গত মাসে নেপালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, চীনের বৃহৎ মহাসড়ক প্রকল্প নেপালের উত্তরাঞ্চলের অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে এবং দেশটির নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে। চীনের এ আচরণে এটি স্পষ্ট যে তার প্রতিবেশীদের কেউ আর নিরাপদে থাকতে পারবে না। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক