প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা: হবে কি হবে না?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

করোনা বা কোভিড-১৯ সারা দুনিয়াকে থমকে দিয়েছে। বাংলাদেশে এই মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এরপর ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সে অবস্থা এখনো জারি আছে।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জীবনযাত্রা কখনোই সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। যদিও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার তা করার পরামর্শ দিয়ে গেছেন। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে আমরা জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়েছি। তার জেরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু শর্ত সাপেক্ষে ছাড় দেওয়া হয়। তার ভালো-মন্দ নিয়ে তরজা চলছেই। তবে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার যে এর ফলে বাংলাদেশে যত ভয়ংকর আকারে করোনা ছড়াবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটা যেমন ঘটেনি, তেমনি দীর্ঘ চার মাসেও আমরা এর কবল থেকে বেরিয়ে আসতেও পারিনি।

দেশের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। নিয়তির ওপর ভরসা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এই নিয়তি ভরসার সবচেয়ে করুণ শিকার শিশু ও বৃদ্ধরা। গ্রামে যাহোক এদের কপালে বাতাস, আলো আর রোদ জুটছে; কিন্তু শহরের বৃদ্ধ ও শিশুরা প্রাকৃতিক আলো-বাতাস থেকেও বঞ্চিত। এর ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। তবে নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েছে এমন খবর তো হররোজ বেরোচ্ছে। বলাবাহুল্য, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। অথচ আমরা তাদের নিয়ে একেবারেই নির্বিকার।

দেশে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে পোশাকশিল্পের মালিকদের জন্য প্রথম রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। ফলে প্রথম ঝুঁকির মুখে ফেলা হয় দরজি মেয়েদেরই। এর সোজাসাপ্টা মানে দাঁড়ায় আমরা নারীর শারীরিক, মানসিক সুস্থতা নিয়ে সামান্য বিচলিত নই। একজন নারী একই সঙ্গে একজন মেয়ে (সন্তান), বোন, স্ত্রী এবং মা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আয়-রোজগারে নারীর অবদান স্বীকারই করা হয় না। কিন্তু এ সমাজে নারীই সামাজিক বন্ধন অটুট রাখেন। সীমাহীন শ্রম দিতে হয় নারীকেই। তা বালিকা কিংবা বৃদ্ধা—যা-ই হোন না কেন। সামাজিক যাবতীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বারো আনা দায় নারীর কাঁধে। শিশুদের ক্ষেত্রে সে দায় তাঁরা ষোলো আনাই বহন করেন। শিশুর জন্মদান, তাকে মানুষ করা, তার নাওয়া–খাওয়া, আদর-সোহাগ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের তদারকি—সব দায়িত্ব নারীর। কখনো বোন, কখনো মা-খালা-চাচি, কখনো দাদি-নানি হিসেবে এই অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নারী পালন করেন। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন ও সংরক্ষণেও নারীর ভূমিকা বিপুল; বলা ভালো, পুরুষের প্রায় সমানই। কিন্তু এসবের কোনোই স্বীকৃতি নেই আমাদের সমাজে। তাই নারীর প্রতি অবহেলার পয়লা শিকার হয় শিশুরাই।

করোনাকালে বাংলাদেশে জীবনযাত্রা অদ্ভুত। কোনো কিছুই বন্ধ নয়, আবার কোনো কিছুই ঠিকঠাক চলছে না। সবচেয়ে অচলাবস্থায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। মানুষ এখন চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে খুবই কম। যাচ্ছে না ভয়ে। সংক্রমণের ভয়। ক্লিনিক, হাসপাতালগুলো রোগীশূন্য। খাঁ খাঁ করছে। আর অচল রয়েছে শিক্ষার চাকা। অনলাইনে কিছু ক্লাস শুরু হলেও তার ভূমিকা একেবারেই নগণ্য। বলা বাহুল্য, শিক্ষায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে শিশুরাই। আর কে না জানে, বাংলাদেশে শিশুদের ওপরই পড়াশোনার চাপ সবচেয়ে বেশি। আর পরীক্ষার চাপ তো অতি ভয়ংকর।

শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে আজগুবি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। তার কত ভাগ এ দেশীয় মস্তিষ্কপ্রসূত আর কত ভাগ চাপিয়ে দেওয়া তা নিয়ে পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞরা পেল্লাই কেতাব লিখতে পারেন। তবে আমি অন্তত এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশে শিশুর কাঁধে বই আর পরীক্ষার বোঝা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি। সে বেশি এতটাই বেশি যে কোনো কোনো দেশের তুলনায় তা ২০ বা ৩০ গুণ বেশি। এশীয় বিচারেও তা সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। তামাম দুনিয়ায় লেখাপড়া আর পরীক্ষা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু এ দেশের দুর্ভাগা শিশুদের জন্য তা অকল্পনীয়। পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণিতেই তাদের ঘাড়ে ‘পাবলিক পরীক্ষা’র বিশ মণি বোঝা! এক দশক ধরে এই সীমাহীন নির্মমতার শিকার আমাদের শিশুরা। এই অতিরিক্ত দুই পরীক্ষার বোঝা চাপানোর পর থেকেই দেশের সচেতন নাগরিক, শিক্ষাবিদ, অভিবাবক সবাই প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করেই চলছে এই অশ্রুতপূর্ব শিশু নির্যাতনের খেলা।

বোঝা যারা বইতে পারে, তাদের কাঁধেই বোঝা সবচেয়ে কম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। স্নাতক বা মাস্টার্স পরীক্ষা নিয়ে হরেক তত্ত্বে দেশ ভেসে যাচ্ছে। তার মধ্যে ‘অটো প্রমোশন’, ‘কম বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণ’, ‘নম্বর কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া’ এমন সব তত্ত্ব নিয়ে দেশ সয়লাব। শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসকদের ঘুম হারাম। এসব পরীক্ষায় বসলে পরীক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসনের কর্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা বাড়তে পারে, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই অবান্তর নয়। কিন্তু ভাবখানা এ রকম যে প্রাথমিক সমাপনী আর জেএসসি পরীক্ষায় কারও কোনোই ঝুঁকি নেই। বছরের অর্ধেক পার হয়ে গেছে। বিগত বছরের ফর্মুলা মানলে সামনে আছে মাত্র তিন মাস। তারপরই এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ পরীক্ষা নিতে হবে। প্রাথমিক সমাপনীর দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা আর জেএসসি পরীক্ষার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। জেএসসি নেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো, প্রাথমিক সমাপনী নেয় নেপ (ন্যাশনাল এডুকেশন ফর প্রাইমারি এডুকেশন)। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে তাদের হ্যাপা কিন্তু কম নয়। রেজিস্ট্রেশন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপা, বিতরণ, কেন্দ্র নির্ধারণ, পরীক্ষা গ্রহণ এমনই কত শত কাজ। জারি করা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব কাজ করা কিন্তু সহজ নয় আদৌ। কিন্তু একেবারে ‘অপ্রয়োজনীয় ও নির্যাতনমূলক’ প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা নিয়ে কেউ রা কাড়ছে না। ফলে কেউ জানতেই পারছে না কী করবে সরকার।

এ বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক লোকের সঙ্গেই কথা বলেছি। তাঁরা সবাই তাঁদের উদ্বেগের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন অসহায়ত্বও। তাঁরা মনে করেন, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, এ দুটি পরীক্ষা চিরতরে বন্ধ ঘোষণা করাই সর্বোত্তম। কেননা, দশক ধরে নেওয়া এই পরীক্ষা আমাদের জন্য সামান্যতম সুফল বয়ে আনেনি। বরং শিক্ষার মতো অতিজরুরি ও নাগরিক অধিকারকে খর্ব করছে। বিপরীতে বিস্তার ঘটিয়েছে বিদ্যা–বাণিজ্য তথা কোচিং–বাণিজ্য। আর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় চর্চা হচ্ছে ভয়ংকর এক দুর্নীতি। আখেরে পঙ্গু হচ্ছে গোটা জাতি।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]