করোনার দেড় শ দিন

যেসব দেশ করোনা মহামারির প্রথম ঢেউয়ের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছিল, তারা যখন রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে এনে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি শিথিল করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছিল, তখন ইউরোপ ও এশিয়ার সেই সব দেশে এই মহামারির সংক্রমণ পুনরায় বাড়তে শুরু করেছে। এটি পুরো মানবজাতির জন্যই একটি অশনিসংকেত।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল কিছুটা দেরিতে, মার্চের ৮ তারিখ থেকে। প্রথমে সংক্রমণের গতি বেশ ধীর ছিল, দুই মাস পর থেকে এখন পর্যন্ত সংক্রমণের শীর্ষাবস্থা চলছে। কয়েক দফা পিছিয়ে সরকার এবং জনগণ আশা করতে শুরু করেছে যে সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির মতো উন্নত বিশ্বের দেশ এবং এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামে করোনার প্রত্যাঘাতের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যাশার আকাশে কালো মেঘ হয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তেমন কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছে না, বরং তারা সতর্ক করে বলছে যে এই ভাইরাসের সঙ্গেই সম্ভবত মানবজাতিকে ভবিষ্যতে বসবাস করতে হবে। অতএব আশার কিছু যদি থাকে তা হলো ভ্যাকসিন। হ্যাঁ, আশার কথা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও ভারত কোভিড-১৯ ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এসব দেশের কোনো কোনো গবেষক দল আগামী অক্টোবরেই টিকা বাজারে প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। রক্ষণশীলের দল সাবধানতার সঙ্গে বলছে, টিকা ডিসেম্বর বা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চের আগে নয়। যখনই হোক টিকা যে আসছে, সেটা প্রায় নিশ্চিত।

ভালো খবর হলো, এই টিকা কোনো দেশই একচেটিয়া কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে না। অনেক দেশ একসঙ্গেই উৎপাদনে যাচ্ছে, তার ওপর এই মহামারি নিয়ে বিশ্বজুড়ে একযোগে উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে এবং বর্তমান বিশ্বায়নের বাস্তবতায় জনস্বাস্থ্য রক্ষার কাজে পুরোনো দেশকেন্দ্রিক ধারণা বাতিল করে বৈশ্বিক বিবেচনাকেই কেন্দ্রে রাখতে হবে। কাউকেই সংক্রমণের ঝুঁকিতে রাখা যাবে না, বিশ্বের কোথাও কোভিড-১৯ ভাইরাসের মৃগয়ার ক্ষেত্র থাকতে পারবে না। অতএব টিকার আওতায় গোটা মানবজাতিকেই আনতে হবে। শিশুদের সমন্বিত টিকার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। করোনার ক্ষেত্রেও এই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগাতে হবে।

২.
এই মহামারিতে প্রথম আক্রান্ত সবই উন্নত দেশ। চীন থেকে পশ্চিম ইউরোপ, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়েছে রোগ। অবশ্য তাদের সঙ্গে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার তুলনা করলে বাংলাদেশ এ রোগ সামলানোর কাজে তেমন খারাপ করেছে, এ কথা বলা যাবে না। সংখ্যাতাত্ত্বিক এই তুলনা ছেড়ে বাস্তব অবস্থা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যেন দুটো বিপরীত চিত্রই দেখতে পাই। সরকার এ রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ব্যবস্থা নিতে একটু দেরিই করেছে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে ইতস্তত ভাব আর কাটেইনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কখনো পরিস্থিতি অনুযায়ী দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেনি এবং এ যুদ্ধের মাঠপর্যায়ের যেটি সদর দপ্তর, সেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ছিল দুর্নীতি ও অব্যবস্থায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মহামারির সময় সরকারি দপ্তরগুলো আকস্মিক বড় অঙ্কের বাণিজ্যকে ঘিরে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, তা–ও প্রথম চিত্রেরই অংশ, যদিও এখানে বেসরকারি ব্যক্তিদের অংশগ্রহণই ছিল মুখ্য। দ্বিতীয় চিত্রটি বরাবরের মতোই সমাজের ভেতর থেকে উঠে এসেছে।
বহুকাল আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ ইউরোপের মতো রাষ্ট্রশক্তির মুখাপেক্ষী নয়, এটি সমাজ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। অধুনা সমাজের নৈতিক এবং সাংগঠনিক নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কথা সকলেই জানি। কিন্তু এর মধ্যেও একেবারে নিম্নবর্গের মানুষ কখনো তাদের কাজ থামায়নি। সরকারি ও কৃষি বিভাগের সব ধরনের সহায়তাকে তারা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে। ফলে কৃষিজ উৎপাদনের ব্যাপক প্রবৃদ্ধির ফলে দেশ মৌলিক খাদ্যে একরকম স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। আর চরম অবক্ষয়ের মধ্যেও সমাজের ভেতরকার পারস্পরিক আত্মীয়তা-সহযোগিতার টান কেটে যায়নি। ফলে দুর্ভিক্ষ–সম্পর্কিত ধ্রুপদি ধারণা খাদ্যাভাবে নয়, বিতরণ-বিপণনব্যবস্থার গলদেই দুর্ভিক্ষ ঘটে থাকে, মজুতদারদের অপতৎপরতার মধ্যেও এখানে কাজ করেনি।’
হয়তো প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ প্রসঙ্গে বারবার তাঁর দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের কথাই বলে থাকেন, হয়তো ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই প্রধান বিরোধী দলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কটাক্ষ করে থাকেন, কিন্তু মাঠপর্যায়ের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে সেখানে সহায়তার নানা উদ্যোগে অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলমতের ভেদাভেদ মুখ্য ছিল না, নেই। বরং একেবারেই অরাজনৈতিক মানবিক চেতনা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসার মানুষই বেশি। গণমাধ্যমে লুটেরা দুর্বৃত্তদের খবর এত বেশি জায়গা নিচ্ছে যে প্রাতিষ্ঠানিক শত দুর্বলতার মধ্যেও দুর্বল সমাজের এই ইতিবাচক সবল ভূমিকা বিশেষ স্থান পায়নি। এটা আফসোসের কথা।

৩.
তবে করোনার বিষয়ে যেটা ভোলার কথা নয় তা হলো এ রোগ অনেকটা জলোচ্ছ্বাসের মতোই, সরে গেলেও দীর্ঘমেয়াদি ছাপ রেখে যাবে। করোনাকালেই আয়-উপার্জন কমে গেছে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অন্তত পৌনে এক কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন। আবার চাকরি বা উপার্জনের অপেক্ষায় থাকা তরুণের সংখ্যাও তো কম নয়। আমাদের সমাজের আপৎকাল সামলানোর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এদিকে শিক্ষার সব স্তর রয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। সংসদ টিভিকে স্কুলশিক্ষার কাজে ব্যবহারের উদ্যোগের প্রশংসা করব। তবে সেই সঙ্গে ভুললে চলবে না স্কুলের কোনো পর্যায়েই শিক্ষকের কাছ থেকে একতরফা শুনে জ্ঞান অর্জনের ভিত পাকা হয় না। ধরেই নেওয়া যায় যে সব পরিবারে সন্তানদের শিক্ষার পরিচর্যার সুযোগ নেই, যেখানে মা–বাবা স্বল্প শিক্ষিত বা শিক্ষিত হলেও অর্থসংকটে সংসারের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতেই ব্যতিব্যস্ত থাকছেন, যে বিপুলসংখ্যক প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদের শিক্ষা ঠিকভাবে এগোচ্ছে না।
যে জায়গায় বড় ঘাটতি ও দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে সেটি হলো পরিস্থিতি অনুধাবন করে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দক্ষতার সঙ্গে তার বাস্তবায়ন। এই দুর্যোগে স্বাস্থ্য খাতের কাজগুলো ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার। সেখানে সময়মতো কাজ হয়নি, দক্ষতার ঘাটতি ছিল প্রচুর এবং দুর্নীতি হয়েছে লাগামছাড়া। এর দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ হলো এত বেশিসংখ্যক চিকিৎসকের করোনা সংক্রমণ ও এতে মৃত্যুবরণ। মোট সংক্রমণের সঙ্গে তুলনা করলে দুটি হারই বেশি।
এটি ভালো যে যাঁরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন, সেই বিনিয়োগকারী এবং যাঁরা খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করেন, সেই কৃষক ও খামারিদের প্রণোদনা দিতে দেরি করেনি সরকার। সিদ্ধান্ত ও ঘোষণায় কিছু প্রাথমিক ভুলত্রুটি থাকলেও এবং এতে অনেকের যথেষ্ট ভোগান্তি হলেও শেষ পর্যন্ত উৎপাদনের কাজ ও অর্থনীতির চাকা যে সচল হয়েছে, সেটি স্বস্তিদায়ক। তবে করোনা মহামারি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে রোগগ্রস্ত কঙ্কালটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে, তার স্বাস্থ্য উদ্ধারে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জাতি অন্ধকারে রয়ে গেছে। শর্ষের ভেতরে ভূত নাকি ভূতের মধ্যে শর্ষে এ নিয়ে গবেষণায় সময় ব্যয় না করে কেবল বলতে চাই, দেশে কার্যকর সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করার জন্য অবিলম্বে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা উচিত।
সেই সঙ্গে আশা করব, যেন এই কমিশনের পরিণতি শিক্ষা কমিশনের মতো না হয়। তবে শিক্ষার কথা তো বাদ দেওয়া যাবে না। এই যে বছরটি শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে কেটে যাচ্ছে, তা কীভাবে পূরণ হবে এবং কীভাবেই বা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা নির্ধারিত হবে, এগুলো নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। এ ক্ষেত্রে বলব, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসকে শিক্ষাবর্ষের ভেতরে রাখতে গিয়ে বহুকাল ছাত্রদের পরীক্ষা ও সেশনের গোঁজামিল বয়ে চলতে হয়েছিল। তেমনটা আর কাম্য নয়, আরও দূরদর্শিতা ও কার্যকরী সিদ্ধান্তই কাম্য।

৪.
শেষ করি একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি দিয়ে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বরাবর সাহসী সক্রিয় কর্মনিষ্ঠ মানুষ। ক্ষমতায় এসে যেভাবে তিনি বিডিআর সংকট সামলেছেন, যেভাবে জঙ্গিদের তৎপরতা থামিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেছেন, পার্বত্য চুক্তি করেছিলেন, আন্তর্জাতিক পরিসরেও যেভাবে বিশ্বনেতাদের আসরে বা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কার্যকর ভূমিকা পালনে স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন, করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে যেন তেমনটি দেখা গেল না। নয়তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অপ্রস্তুত অবস্থা এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির এমন খোলামেলা হাল এত দিন কেমন করে চলতে পারে? পারে শুধু ব্যবস্থা নিতে দেরি হলেই।
এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি সব কাজে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এমন একটি দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যাপক জাতীয় সামাজিক উদ্যোগ দরকার, তার প্রতি সরকারের আগ্রহ দেখা যায়নি। সরকার আমলাদের ওপরই নির্ভরশীল থেকেছে। জেলা পর্যায়ে কাজে গতি আনতেও তাই দলীয় নেতা নন, সচিবদেরই মুখাপেক্ষী হয়েছে সরকার। আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও জানেন এখন যে কাল চলছে তাতে ছোট–বড় আমলারাই কর্তা, তাঁরা পার্শ্বচরিত্র। ফলে মাঠপর্যায়ে সরকারি দলের নেতা–কর্মীদের মধ্যে সে রকম স্বতঃস্ফূর্ত কর্মোদ্যোগ চোখে পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে করোনা ইস্যুতে তাঁর দলকে যে রকম চাঙা অবস্থায় মাঠে দেখার কথা ছিল, সেটা কিন্তু ঘটেনি।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক