'পরস্পর যুক্ত হলেই মানুষ বাঁচে'

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
>করোনার অতিমারিতে মানুষ উৎকণ্ঠিত, অবসাদগ্রস্ত। এমন দুর্যোগ পেরিয়ে মানুষ বেঁচে থেকেছে যুক্ত হওয়ার শক্তিতে। এই সময়েও নিজেকে জাগিয়ে রাখার প্রেরণা দিচ্ছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম।

প্রথম আলো: এই মহামারির মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন আছেন আপনি?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করা হলে বলব, দুটো জিনিস আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। একটা হলো, বহু প্রিয় মানুষকে এই সময়ের মধ্যে হারিয়েছি। বয়স বেশি হওয়ায় আমার বন্ধুবান্ধব, নিকটজনের সংখ্যা অনেক বেশি। এই কোভিড মহামারির সময় বেশ কিছু মানুষকে হারিয়েছি, যাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়, মেলামেশা বহুকাল ধরে। এ বিষয়টা আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছে।

আরেকটা হলো, মহামারি নিয়ে প্রতি মুহূর্তের উৎকণ্ঠা। আমার বয়স হয়েছে। বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কম হয়। তরুণ-যুবকদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বয়স্কদের তুলনায় বেশি থাকে; তারা হয়তো অনেকে পার পেয়ে যায়।

আমাদের শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের প্রায় ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন না; তাঁদের অনেকে আমাদের মতো আধুনিক চিকিৎসাসেবা ও সুরক্ষার মধ্যে নেই। ফলে তাঁদের প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া রোগ প্রতিরোধক্ষমতা প্রায় অটুট অবস্থায়, তাঁরা প্রায় আদিম মানুষের শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সে তুলনায় দুর্বল। সে কারণে করোনাভাইরাস নিয়ে আমার নিজের এবং বয়স্ক সবার জন্য উৎকণ্ঠা বোধ করি।

প্রথম আলো: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বাইরে এই সময়ে নতুন কোনো উপলব্ধি হলো?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ঘরে অবরুদ্ধ সময় কাটানো বিষয়ে একটা ভাবনার কথা বলি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক মানুষকে বছরের পর বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তাঁরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বছরের পর বছর ধরে অনেক দুঃখকষ্ট স্বীকার করেছেন। তাঁদের কষ্টের তুলনায় আমাদের কষ্ট কতটুকু! আমরা হয়তো এক-দেড় বছরের মধ্যে ভ্যাকসিন পাব। তখন মানুষ আবার মানুষের কাছে ফিরে আসতে পারবে। এখন মানুষ যেন মানুষের শত্রু হয়ে বসে আছে। আমি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্বাসিত। বিচ্ছিন্নতা মানুষের জন্য বিপজ্জনক। একটা বিষয় যদি ভেবে দেখি, প্রকৃতিতে মানুষই সবচেয়ে অরক্ষিত প্রাণী বলে মনে হয়। বিভিন্ন প্রাণীর আত্মরক্ষার জন্য নানা রকমের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে। কারও দাঁত, কারও নখ, কারও বিষ ইত্যাদি থাকে। কিন্তু মানুষের তেমন আত্মরক্ষার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ সবচেয়ে অসহায়, সবচেয়ে অরক্ষিত প্রাণী। এই অসহায় অরক্ষিত প্রাকৃতিক অবস্থার মধ্যে মানুষ কী করে টিকে থাকল? টিকে থাকতে পেরেছে এ জন্য যে মানুষ মানুষকে সহযোগিতা করে, মানুষ মানুষের জন্য দাঁড়ায়। পরস্পর যুক্ত হলেই মানুষ বাঁচে। এভাবেই মানব জাতি নিজেকে রক্ষা করে। সুতরাং মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি পরস্পর নির্ভরশীলতা। মানুষ টিকে রইল মানুষেরই জন্য। আজকে সেই মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। অতীতে কখনো মানুষ এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়নি।

প্রথম আলো: এই মহামারিকালে কিছু মানুষের মধ্যে, তাদের সংখ্যা খুব কম হলেও বেশ দুঃখজনক ও অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। যেমন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এমন মানুষকে কবর দিতে বাধা দেওয়া; কিংবা কোভিডে আক্রান্ত পরিবারকে একঘরে করা; ভাড়া বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া...। এসব ঘটনা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ওই যে বললাম, মানুষ আর মানুষের পাশে নেই, কোনোভাবেই নেই। এই যে মানুষ সরে গেছে, কবর পর্যন্ত দিতে দিচ্ছে না—এসবই হচ্ছে রোগাক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক থেকে; অজ্ঞতা থেকেও। এখন হাসপাতালে রোগীর কাছে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ; বাসায় স্বজন আক্রান্ত হয়েছে, তার কাছে যাওয়াও একই রকম ঝুঁকিপূর্ণ। সে জন্য বিচ্ছিন্নতা। এমনই এক ছোঁয়াচে সংক্রামক রোগ এসেছে যে মানুষ মানুষকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রথম আলো: আবার এসব ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কিন্তু লক্ষ করা গেছে। কোভিড আক্রান্ত পরিবারকে ভাড়া বাসা থেকে বের করে দেওয়া, কিংবা কবর দিতে বাধা দেওয়া—এসব ঘটনার প্রতি সমাজ বিরূপ প্রতিক্রিয়া করেছে...
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, এর মানে, আতঙ্কগ্রস্ত হলেও সমাজের সব মানুষ মানবিক সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলেনি। নির্মমতা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আরেকটা বিষয়, আমরা এক ঊর্ধ্বশ্বাস জীবনের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। সবাই ছুটছিল, কারও ব্যক্তিগত সময় ছিল না। কারণ, সব সময় কিনে নেওয়া হয়েছে, সব সময় বিক্রি করা হয়েছে।

পুঁজিবাদী সভ্যতা মানুষকে সব সময় কিনে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো মানুষের সময় ছিল না। কোভিড মহামারির অবরুদ্ধ দশায় আমি প্রথম দেখলাম, আগে যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইত, ব্যস্ততার জন্য সময় পেত না; এখন তারা ফোন করছে, অনলাইনে যোগাযোগ করছে। কোনো প্রয়োজনে নয়, হৃদয়ের চাহিদা থেকে যোগাযোগ হচ্ছে। প্রকৃত মানুষ জেগে উঠেছে আমাদের ভেতরে, যে মানুষ মানুষকে খোঁজে, যে মানুষ মানুষকে চায়। আগে কথা বলত, কাজের, প্রয়োজনে, লাভালাভের কথা। আজকের কথাগুলো ভালোবাসার, বেদনার, দুঃখের বিনিময়। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ কাছে চলে এসেছে। মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা সম্পূর্ণভাবে যায়নি।

প্রথম আলো: পৃথিবীর একটা বড় অংশ বড় আকারের মহামারিতে সর্বশেষ বিপর্যস্ত হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর আগে। সে সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। কিন্তু এই একুশ শতকে এসে প্রায় পুরো পৃথিবী একই সঙ্গে মহামারিতে অচল হয়ে পড়ল।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমরা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করেছি, লোভের সীমা লঙ্ঘন করেছি। লোভ, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাড়াবাড়ি করেছি। অতীতে এ রকম পর্যায়ে মহাপুরুষেরা সমাধানের পথ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন আমরা তাও পাচ্ছি না। আমি একসময় মনে করতাম, প্রকৃতি হচ্ছে অচেতন প্রকৃতি, আর মানুষ সচেতন ও মেধাবী প্রকৃতি। কিন্তু এখন আমি এ ধারণা থেকে সরে এসেছি। এখন আমার ধারণা, প্রকৃতি অন্তহীন চৈতন্যসম্পন্ন, প্রকৃতি বুদ্ধিমান। এবং এই অন্তহীন বিশ্ব চরাচরের সমাপ্তি আমরা খুঁজে পাব না। আমি বিশ্বাস করি যে প্রকৃতির মধ্যে একটা চৈতন্য থাকার কথা; নইলে তা টিকে থাকতে পারত না। প্রকৃতি সুবিন্যস্ত, স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং যান্ত্রিকভাবে তার নিজস্ব নিয়মে নিখুঁতভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

প্রথম আলো: আমরা একটা অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি বটে; কিন্তু কীভাবে এই সময়টার সদ্ব্যবহার করা যায়; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষাদ-একঘেয়েমির মধ্যেও কীভাবে একটু ভালো থাকা যায়—এ রকম কী ভেবেছেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অধিকাংশ মানুষ একরৈখিক জীবন যাপন করে। প্রত্যেক মানুষ তার কাজের ক্ষেত্রের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে যায়। কিন্তু যে মানুষ নিজের মনের মধ্যে অনেকগুলো ভুবন তৈরি করতে পারে, সে অবরুদ্ধ অবস্থায় তার কাজের ক্ষেত্রের বাইরে অন্য কোনো ভুবনে আশ্রয় নিতে পারে। আমাদের যার পেশা যা-ই হোক না কেন, সবারই উচিত, বিভিন্ন ভুবন গড়ে তোলা। নানা রকম চর্চা, যেমন সংগীত, বিচিত্র বিষয়ে বইপত্র পড়া, চিত্রকলার চর্চা ইত্যাদি।

প্রথম আলো: আপনি নিজে কীভাবে কাজে লাগালেন সময়টা?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অবরুদ্ধ এই সময়টা ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই উপকারে আসছে। আমার স্বপ্ন ছিল অনেক লেখালেখি করার। কিন্তু নানা ধরনের কাজে, সাংগঠনিক কাজে জড়িত থাকায় লেখালেখির কাজে ঠিকমতো বই বেরিয়েছে বটে, কিন্তু বইগুলো শোধন করা হয়নি। এখন সেই সময়টা পেয়েছি, এই সময়টা খুব আনন্দের সঙ্গে কাজে লাগাতে পারছি। বইগুলো মোটামুটিভাবে সংশোধন করছি।

প্রথম আলো: আপনার তো অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলোই কি সংশোধন করছেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না। আমার ৪০টা বই বেরিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রিয়, যেগুলো সম্পর্কে অনেকের ভালো মন্তব্য শুনেছি, সেগুলো সংশোধনের কাজ করছি। ইতিমধ্যে সেগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের মোটামুটি সংশোধন সম্পন্ন হয়েছে। মহামারি পরিস্থিতি তো আরও দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে হচ্ছে। আশা করি সে সময়ের মধ্যে পুরোটাই সংশোধন করা সম্ভব হবে।

প্রথম আলো: নিজের বইগুলো সংশোধন করার পাশাপাশি নিশ্চয়ই অনেক কিছু পড়েছেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি নানা ধরনের জিনিস একই সময়ে পড়ি। সংগীত শুনি। চলচ্চিত্র দেখি। ইন্টারনেটের কারণে এখন চলচ্চিত্র দেখা অনেক সহজ হয়েছে।

প্রথম আলো: কেউ কেউ বলছেন, কোভিড মহামারি পৃথিবীকে বদলে দেবে; মানুষ বদলে যাবে। আপনার কী মনে হয়?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমরা অনেক অহংকারী হয়ে উঠেছিলাম, দাম্ভিক হয়ে উঠেছিলাম। আমরা বিশ্বাস করতাম যে আমরা প্রকৃতিকে জয় করেছি, পদানত করেছি। এই দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। যে পরিমাণ ভাইরাস ২০ লাখ মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে, তার ওজন এক ফোঁটা পানির ওজনের সমান। সুতরাং আমাদের দম্ভ অর্থহীন। আমরা যে লোভ, লালসা, বিলাস, প্রতিযোগিতায় উন্মাদ হয়ে যন্ত্রের স্বভাবের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম, সেসব অর্থহীন। এবং এইটাই শেষ নয়; মানুষ প্রকৃতির যে ক্ষতি করেছে, এ রকম মহামারি হয়তো ফিরে ফিরেই পাব। বস্তুগত লাভের জন্য প্রকৃতির ভারসাম্য, সূচিতা, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আমরা ধ্বংস করেছি। আমার মনে হয়, এই মহামারি আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। আমার মনে হয়, আমরা বুঝতে পারব, যান্ত্রিক হওয়া নয়, প্রাকৃতিক হওয়াই মানুষের ভবিতব্য। এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানই মানব জাতির ভবিষ্যৎ।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ধন্যবাদ।