সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি বৈষম্য বাড়াচ্ছে

একটি পরিবারের তিনজন কোভিডে আক্রান্ত হলো। তাদের আবার ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা গেল। এই পরিস্থিতিতে শুধু তাদের ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ কত খরচ হলো ৮১,০০০ + ৩০,০০০= ১,১১,০০০ টাকা। হিসাবটা মনগড়া বা বানানো নয়, একদম বাস্তব।

খরচের বহর এখানেই শেষ হচ্ছে না, রক্তে সংক্রমণ থাকায় দুজনকে আবার ইনজেকশন দিতে হয়। সে জন্য এক হাসপাতাল থেকে একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে পরিস্থিতি জানিয়ে আনা হলো। ১৪ দিনে তাঁকে দিতে হলো ২৫ হাজার টাকা। অসুখ ও এই খরচের কারণে মানুষটি বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন। এটা কাটিয়ে উঠতে তাঁকে অনেক বেগ পেতে হবে। অথচ তাঁর কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থাকলে ব্যাপারটা সহজ হতো।

যার পরিবারের উদাহরণ দেওয়া হলো, সেই ব্যক্তি আয়ের নিরিখে তথাকথিত মধ্যবিত্ত। বেসরকারি কর্মজীবী। তিনি সেই হারিয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের কাতারে, যাদের উদ্দিষ্ট করে দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণীত হয় না। তাঁদের না আছে সরকারি সুরক্ষা, না আছে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পেনশন। সম্প্রতি সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক ওয়েবিনারে জানানো হয়, দেশের উঠতি মধ্যবিত্তের ৬০ শতাংশের কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা বা পেনশন নেই। উল্লিখিত পরিবার অনেকটা সেই শ্রেণিভুক্ত। সুরক্ষা বলতে অফিসের নগণ্য এক স্বাস্থ্যবিমা, যেটা আবার মহামারির বেলায় প্রযোজ্য নয়। ফলে বাস্তবতা হচ্ছে, এই ধরনের পরিবার বড় অসুখে পথে বসে যেতে পারে। আর এই ঘটনা নিম্নবিত্ত বা গরিব মানুষের পরিবারে ঘটলে কী হতো, তা কল্পনাতেই থাকুক।

কোভিড-১৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। বরাদ্দ দিয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। জিডিপির অনুপাতে যা ৩ দশমিক ০১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এই বরাদ্দ কম নয়। তবে এর মধ্যে সরকারের পেনশন অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ব্যাপারটা অনেক লঘু হয়ে যায়। সে কারণে দেখা যায়, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ এই সুরক্ষার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে জনগোষ্ঠীর অনুপাতেও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না বলে সানেম অভিযোগ করেছে। তারা দেখিয়েছে, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা জনসংখ্যার ৯ শতাংশ হলেও তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষার ২ শতাংশ। আর বয়স্ক জনগোষ্ঠী দেশের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হলেও তাঁদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৭২ শতাংশ। এর সঙ্গে দরিদ্র মানুষ চিহ্নিতকরণে বড় ধরনের সমস্যা তো আছেই।

সরকারি সুরক্ষা যেমন নেই, তেমনি ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরেও সুরক্ষা নেই বললেই চলে। এই ব্যাপারে সমাজে সচেতনতাও বিশেষ নেই। নাগরিক সমাজকেও এ নিয়ে বিশেষ কিছু করতে দেখা যায় না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে স্বল্প অঙ্কের স্বাস্থ্য ও গোষ্ঠী বিমা আছে। কিন্তু সেগুলো সব ধরনের অসুখে প্রযোজ্য নয়। দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিমা আছে, কিন্তু তারাও যেমন সেগুলোর তেমন একটা প্রচারণা দেয় না, তেমনি মানুষও তাদের ওপর ভরসা পায় না।

দেশে গত ১০ বছরে যেমন প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, তেমনি আয়–বৈষম্যও বাড়ছে। জিনি সহগের মান বাড়ছেই। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক সুরক্ষার অভাবে বৈষম্য আরও তীব্র হচ্ছে। উচ্চ আয়ের মানুষেরা নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারছেন। কিন্তু স্বল্প বা নিম্ন আয়ের মানুষদের পক্ষে তা অত্যন্ত কঠিন। অন্যদিকে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় সবচেয়ে বেশির কাতারে। দেশের মানুষের আয়ু বাড়লেও মেডিকেল পভার্টি বা স্বাস্থ্যগত দারিদ্র্যের মাত্রা বেশি। ফলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি বিশেষ সুখকর হয়নি। বয়স হলে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের পেছনেই দৌড়াতে হয়। এই খরচ সবার ক্ষেত্রেই কমবেশি একই রকম।

সরকারি হাসপাতালে সেবার সীমাবদ্ধতা ও হয়রানির কারণে সিংহভাগ মানুষ সেখানে যেতে চান না। অগত্যা গন্তব্য সেই বেসরকারি হাসপাতাল, যদিও সেখানে প্রকারভেদ আছে। ধনীদের জন্য সেটা সমস্যা নয়। কিন্তু সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া বা মধ্যম মানের বেসরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে সেই খরচ প্রায় একই। সমস্যা হচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী পেনশন পান, কিন্তু বেসরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া মানুষটি পেনশন পান না, অথচ এঁরাই সমাজের সিংহভাগ। আবার বেসরকারি হাসপাতালের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এই মহামারির সময়েও তাদের অমানবিক আচরণ নিয়ে অনেক অভিযোগ শোনা গেছে। এই ব্যবধান কোনো সময় জীবনে অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তাই এই ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বেশি।

অন্যদিকে, বেশ কয়েক বছর ধরেই সর্বজনীন পেনশনের কথা শোনা যাচ্ছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েক বছর বাজেট ঘোষণার সময় এই সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এখন কথা হচ্ছে, এই যে দেশের উঠতি মধ্যবিত্তের ৬০ শতাংশের কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা বা পেনশন নেই, তাদের প্রতিও রাষ্ট্রের করণীয় আছে। তারা তো কোভিড মোকাবিলায় সরকার-ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাভোগী নয়। কিন্তু কোভিডের কশাঘাতে অনেকের বেতন/বোনাস কমে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে ভাটা। এর সঙ্গে যদি উল্লিখিত পরিবারের মতো কোভিডে আক্রান্ত কেউ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এই পরিস্থিতিতে সর্বজনীন পেনশন এখন সময়ের দাবি। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অনেক দেশেই আছে। বাংলাদেশ এ–বিষয়ক জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষর করলেও এ নিয়ে সরকার বা নাগরিক সমাজ কেউই বিশেষ উচ্চকণ্ঠ নয়। শিক্ষাবিমাও জরুরি। এসব সুরক্ষার অভাবে মানুষ যেমন উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি সমাজে বৈষম্য বাড়ছে।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।