যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখতে হাত মেলাচ্ছে চীন ও ইরান

ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে চুক্তি চীনকে শক্তিশালী করবে। ছবি: রয়টার্স
ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে চুক্তি চীনকে শক্তিশালী করবে। ছবি: রয়টার্স

চলতি মাসের গোড়ার দিকে ইরান ঘোষণা করেছে, তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য, জ্বালানি, অবকাঠামো, টেলিকমিউনিকেশন এবং সামরিক সহযোগিতাবিষয়ক ২৫ বছরের একটি চুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের সঙ্গে ইরানের এ ধরনের চুক্তিতে যাওয়ার সময়কালটি অত্যন্ত লক্ষণীয়। সময়টি ইরানের জন্য অত্যন্ত সংকটজনক। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বোপরি কোভিড-১৯–এর হানা—সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে ইরান সরকার। দেশের জনগণকে শান্ত রাখাই তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ইরানে একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনায় পরমাণু কার্যক্রম ও ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রমসংশ্লিষ্ট কমপক্ষে দুটি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হাত আছে বলে মনে করা হচ্ছে এবং এতে ইরানের আত্মরক্ষার ক্ষমতা সম্পর্কে সাধারণ ইরানিদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলের ওপর ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে কি না, ইরান চুক্তি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ভর করছে।

এসবের মধ্যে ইরান চীনের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার বিষয়ে এমন ঘোষণা দিল।

মনে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকভাবেই ইরান কোনো বড় শক্তির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে গেলে বরাবরই বাধার সম্মুখীন হয়েছে এবং কোনো বৃহৎ শক্তি ইরানের ওপর অর্থনৈতিকভাবে খবরদারি করবে, এটি তারা কখনোই মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে ইরানের অভ্যন্তরেই চীনের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার বিরোধিতা আসছে।

ইরানকে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ দিতে ২০১৮ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরিয়ে আনেন এবং বড় বড় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তখন থেকেই ইরানের অর্থনীতিতে ধস চলে আসছে। দেশের ভেতরে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়েছে সরকার।

চীনের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দিয়ে রুহানি সরকার জনগণের কাছে এই বার্তা দিতে চান যে ইরান তার সব ডিম পশ্চিমা বাস্কেটে রাখতে চায় না। সরকার জনগণকে বোঝাতে চায়, ইরান বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান বরাবরই ভারসাম্য রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে এসেছে। গত দশকে যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানি থেকে বাঁচতে ইরান প্রতিরক্ষা ইস্যুতে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে, আর্থিক খাত ইস্যুতে চীনের দিকে হাত বাড়িয়েছে এবং নানা ইস্যুতে রুহানি সরকার ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। এখন চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের মধ্যে ইরান চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া মজবুত করছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপের মধ্যে রাখা যায়। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে ভবিষ্যতে ইরান চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আলোচনা করতে এলে তাদের সঙ্গে দেনদরবার করা সহজ হবে। এ ছাড়া এই চুক্তি হলে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও চাপে রাখা যাবে।

অন্যদিকে, এই চুক্তিকে ইরানও যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখার অস্ত্র হিসেবে দেখছে। তবে এটিও ঠিক, সৌদি আরব ও ইসরায়েল ইরানের জানি দুশমন হলেও তাদের সঙ্গে চীন তার সম্পর্ক নষ্ট করতে আগ্রহী হবে না।

চীন অবশ্যই ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় ইরানের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়নে ইরানের সহযোগিতা একটা বড় ভূমিকা রাখবে। ইরান থেকে চীন ইতিমধ্যেই বাজারদরের চেয়ে কম মূল্যে তেল কিনছে। এ ছাড়া আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় সেখানে চীনের দৃষ্টি আছে। আফগানিস্তানে চীনা উপস্থিতি সংহত করতে ইরানের সহযোগিতাও দরকার হবে।

ইরানের সঙ্গে চুক্তি হলে চীন ইরানের চাহবাহার বন্দরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, যা তার প্রতিপক্ষ ভারতকে কোণঠাসা করার কাজে লাগবে। ভারত বর্তমানে এই বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনা–নেওয়া করে থাকে।

এর বাইরেও বহু ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে চুক্তি চীনকে শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, সন্দেহ নেই, সেই যুদ্ধে ইরান চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ওয়ালি নাসর জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিডল ইস্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক

আরিয়ানে তাবাতাবাই কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র রিসার্চ স্কলার