করোনাকালে নিয়তিবাদ আমাদের কী শেখায়?

ব্যাধির চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় মহামারিকালে মানুষ নিয়তিবাদী হয়ে পড়ে। করোনার সময়ে বাজারে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো
ব্যাধির চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় মহামারিকালে মানুষ নিয়তিবাদী হয়ে পড়ে। করোনার সময়ে বাজারে মানুষের ভিড়। ছবি: প্রথম আলো

মহামারির সঙ্গে নিয়তি কিংবা অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করার প্রবণতা বিশ্বজুড়ে অনেক আগে থেকেই লক্ষণীয়। সাধারণ অর্থে মানুষ যখন তার জীবনের কোনো ঘটনাকে এমন কোনো বিষয় দ্বারা পরিচালিত হতে দেখে, যেখানে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, বিশেষত সেই অবস্থায় ব্যক্তি যখন বৃহত্তর শক্তির ওপর আস্থা রাখে, তাকে অদৃষ্টবাদ বা নিয়তিবাদ বলা হয়।

প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মধ্যযুগের ইউরোপের বিভিন্ন সমাজেও মহামারির সময়ে মানুষের মধ্যে অদৃষ্টের ওপর বিশ্বাস করার ব্যাপক প্রবণতা ছিল। সে সময়ে মহামারিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করা হতো। এর মধ্যে একটি অন্যতম ব্যাখ্যা ছিল, মহামারিকে কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে দেখা। পাশাপাশি যারা এই মহামারির শিকার হতো, তাদের দেখা হতো সমাজের ঘৃণিত বা নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে। এ ধরনের আচরণ নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে অধিক হারে দেখা যেত। এ ক্ষেত্রে আমরা প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা আমাদের এই অঞ্চলের কলেরা রোগের কথা উল্লেখ করতে পারি। যেসব সংক্রামক ব্যাধির দীর্ঘ সময় ধরে কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না, সেসব ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে অদৃষ্টের বা ভাগ্যের ওপর অধিক হারে নির্ভর করার প্রবণতা ছিল।

মানুষের এই ধরনের অদৃষ্টবাদী ধারণা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে শুরু করে বিশ্বজুড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে যখন ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, তখন থেকে মানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদী চিন্তার বাইরেও মহামারিকালে প্রগতিশীল ও আশাবাদী ধ্যানধারণার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা এবং মহামারির মতো বিষয়কে একটি যৌক্তিকতার মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

তবে অদৃষ্টবাদী ধারার এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া শুরু হলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সেই চিন্তাভাবনা পৌঁছতে অনেক বেগ পেতে হয়। কেননা, বিংশ শতকের শুরুর দিকে কলেরা বা স্প্যানিশ ফ্লুর মতো নানাবিধ সংক্রামক রোগের যে বিস্তার ঘটে, তার বিপরীতে মানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদী ধারার প্রচলন বেশ প্রকটভাবে রয়ে যায়। এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ ছিল সংক্রামক ব্যাধির নিরাময়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার অপারগতা। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত, যা সাম্প্রতিক করোনাকালেও দেখা যায়। তা হলো সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা যখন অধিকতর, সে ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একধরনের নৈরাশ্যবাদী ধ্যানধারণা প্রবলভাবে বিস্তার করতে থাকে। এর ফলে অনেক মানুষই নৈরাশ্যবাদ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়।

করোনাকালে আমাদের সমাজেও অনেকের মধ্যে এ ধরনের নিয়তি কিংবা অদৃষ্টের ওপর অতিমাত্রায় বিশ্বাসী হওয়ার প্রবণতা দেখতে পাই, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে চলা কিংবা মাস্ক ব্যবহারের অনীহার মাধ্যমে। এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়: প্রথমত, আমাদের দেশের অনেকের মধ্যেই করোনাকালের শুরুতে একটি প্রবল ধারণা ছিল যে আমাদের মতো সমাজ করোনা দ্বারা সংক্রমিত হবে না।

দ্বিতীয়ত, যখন কিনা করোনা আমাদের দেশে এসেই গেল, তখন দীর্ঘ সময় ঘরবন্দী মানুষ তার জীবন ও জীবিকা নিয়ে অধিকতর চিন্তিত হতে শুরু করে। যার ফলে আমরা দেখতে পাই মানুষের অবাধ চলাচলের মধ্যে। এখানে যে কেবল জীবিকার তাগিদেই মানুষ বাইরে বের হচ্ছে, বিষয়টি কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমন নয়। অনেকেই আর ঘরবন্দী জীবন যাপন করতে চাইছেন না, বরং তারা তাদের পূর্ববর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ছেন। আর তাই অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘যা হওয়ার হবে, আর এভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব না’। এখানে স্পষ্টতই মানুষের অদৃষ্টবাদের ওপরে আস্থা রাখার বিষয়টি প্রকাশিত হচ্ছে। আর তাই অনেকে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পুরোপুরি স্রষ্টার হাতে ন্যস্ত করে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে চান, অন্তত এই করোনাকালে।

এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ, অর্থাৎ অদৃষ্টের ওপর ভরসা করার বিষয়টির সঙ্গে কেউ কেউ করোনা মোকাবিলার মানসিক শক্তি জোগানোর বিষয়টিও নিয়ে আসেন। এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত লারা ফ্রিদফেল্ড নামের একজন লেখক উল্লেখ করেন, করোনাকালে অদৃষ্টবাদ আদতে আমাদের আরও সাহস জোগাতে পারে। তিনি তাঁর লেখার উপসংহার টানেন এভাবে, যদিও জনস্বাস্থ্য মোকাবিলায় অদৃষ্টবাদ কোনো পদ্ধতি হতে পারে না, কিন্তু যখন আমরা আধুনিক বিজ্ঞান ও সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ সীমাবদ্ধতা দেখি, তখন অদৃষ্টের ওপর ভরসা করার মধ্য দিয়ে আমরা কিছুটা হলেও শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। এর মাধ্যমে মানুষ কিছুটা হলেও নিজেদের শান্ত রাখতে পারবে, যা পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করতে সাহায্য করতে পারে।

সাম্প্রতিক করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর তীব্র অনাস্থার বিষয়টিও অনেককে এই ধারায় বিশ্বাসী হতে বাধ্য করে। এ–বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে একটি গবেষণায় আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় যে চিকিৎসাবিষয়ক বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার কারণে অনেকে আরও বেশি অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েন। অর্থাৎ যখন কিনা সমাজের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় কিংবা ভরসার জায়গা কমে যায়, তখন মানুষ আরও বেশি অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠতে পারে। একই ধরনের প্রবণতা আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যে দেখতে পাই।

আবার যদি আমাদের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা কিংবা লোকসংস্কৃতির কিছু কিছু ধারার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের দার্শনিক চিন্তার আদিরূপ এর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। যেমন লোকসংগীতের অনেক গানের কথায় অদৃষ্টের ওপর ভরসা করার প্রতি জোর দেওয়া হয়। আবার আমাদের সমাজের একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো ‘বিধির বিধান না যায় খণ্ডন, ললাটলিখন না যায় পড়া’—এটা পরিপূর্ণভাবে অদৃষ্টের ওপর নির্ভরশীলতার কথা বলে। এ ধরনের অসংখ্য উপমা আমরা নিয়ে আসতে পারি, যা অনেককে অদৃষ্টবাদী হতে উৎসাহিত করে। করোনাকালে সেই ভাবনা আরও বৃদ্ধি পেলে তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই।

আবার এ ধরনের আচরণ কেবল আমাদের এখানেই দেখা যাচ্ছে, সেটাও বলা যাবে না, কেননা ইউরোপসহ পশ্চিমা অনেক দেশেই করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলার প্রকোপ লক্ষ করা যায়। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য অনেককে এমনকি আন্দোলনে নামতেও দেখা গেছে, যার উদাহরণ অনেক। করোনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যেহেতু করোনার সঙ্গে মৃত্যুর বিষয়টি অন্যান্য রোগের তুলনায় অনেক বেশি সম্পর্কিত, তাই অনেকের মধ্যেই প্রতিরোধমূলক আচরণ যেমন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কিংবা নিয়মিত হাত ধোয়ার বিষয়গুলোর প্রতি তাদের উদাসীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান।

যদিও অনেক মানুষ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যাদের অনেকেই হয়তো অনেকটা অসচেতনভাবেই ক্রমাগত অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি আমরা নিজের স্বাস্থ্য ও তার নিরাপত্তার দিকে নজর না দিয়ে অদৃষ্টের ওপর অতিমাত্রায় ভরসা করি, তাহলে সংক্রমণ আরও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। সে বিচারে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রতি জোর দিয়েই নিজ নিজ কাজ চালানোর একটি লম্বা অভ্যাস আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কেননা, আমরা এখনো জানি না করোনা–পরবর্তী বিশ্বের জীবনপ্রণালি কেমন হবে।

বুলবুল সিদ্দিকী: সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক সেন্টার ফর পিস স্টাডিস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।