সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ড

কক্সবাজারের টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনাটি মর্মান্তিক। সব মৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডই বেদনাদায়ক। কিন্তু পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুর যে বিবরণ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। এটি মানুষের মনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিশপ্ত অধ্যায়টিকেই নতুন করে সামনে এনেছে।

হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ পুলিশের এজাহারে আছে, তাকে সত্য ধরে নিলেও এটা বলা যায় যে এই হত্যাকাণ্ড এড়ানো সম্ভব ছিল। অন্যদিকে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজরের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁকে স্পষ্টতই হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি ছুড়েছে, এটা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও ঘটনার যে বিবরণ পাওয়া গেছে, তাতে পুলিশের ভাষ্যের মিল পাওয়া যায় না।

যেকোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরে একটা গৎবাঁধা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশই বহুকাল ধরে রীতি হিসেবে চলে আসছে। এটা বোধগম্য যে নিহত ব্যক্তির পদমর্যাদা এবং এ ঘটনায় জনমনে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়েই হয়তো এবার তদন্ত কমিটি গঠনের একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার পর গত রোববার শামলাপুর চেকপোস্টের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ ১৬ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আমরা আশা করব, কমিটি গঠন করা আর কোনো বিষয়কে হিমাগারে পাঠানোর যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার ধারাবাহিকতায় এটা হারিয়ে যাবে না। নির্ধারিত সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি তদন্তকাজ শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করবে, সেটাই প্রত্যাশিত। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, ঘটনাটি স্মরণকালের মধ্যে ব্যতিক্রম এবং নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থে এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি খুবই জরুরি। আমরা মনে করি, তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অনাবশ্যক গোপনীয়তা বা আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হলে তা মানুষের মধ্যে অহেতুক সন্দেহ-সংশয় তৈরি করবে। সাধারণ মানুষ সত্য জানতে চায়। আর এই ঘটনায় আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে এবং কেউ অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হলে তার যথাযথ আইনি বিহিত দেখতে চায়।

করোনাকালে মানুষ এমনিতেই নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। তার ওপরে দেশে অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জনগণের মনস্তত্ত্বে একটা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সাম্প্রতিক সময়ে মলিন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে আমরা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে সংবেদনশীল সচেতনতা লক্ষ করেছি। করোনাকালেও পুলিশ সার্বিক বিচারে প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলছে। টেকনাফের ঘটনাটি পুলিশের জন্য এক বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হবে। অপরাধ দমনের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বেছে নেওয়ার কৌশল নীতি হিসেবে কতটা বিপজ্জনক এবং এর পরিণতি কতটা করুণ ও মর্মান্তিক হতে পারে, পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু তারই দৃষ্টান্ত। 

পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, সিনহা তাঁর জীবনকে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন দেখতেন। কক্সবাজারের এসপি নিজেই বলেছেন, নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর একটি তথ্যচিত্র ধারণের কাজে আরও চারজন সঙ্গীসহ এক মাস ধরে হিমছড়ির একটি রেস্টহাউসে অবস্থান করছিলেন। এ রকম অবস্থায় ৫০টি ইয়াবা বড়ি ও কয়েক বোতল বিদেশি মদ এবং ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি ও হত্যাকাণ্ড—সবকিছুই বিভ্রান্তিকর।

 আমরা দ্রুত সত্য ঘটনা জানতে চাই। দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি চাই।