ভ্যাকসিন নিয়ে পরাশক্তিগুলোর রাজনীতি

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

কোভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ধুন্ধুমার রাজনীতি চলছে। কে কার আগে আবিষ্কার করবে এবং বাজার দখল করবে, তা নিয়ে পরাশক্তিগুলো টিকাযুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিদিনই টিকা নিয়ে নিত্যনতুন তথ্য আসছে। ওষুধ কোম্পানি, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে টিকার পেছনে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হিসাব অনুসারে, এ পর্যন্ত ২০২টি টিকা তৈরি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২৭টি টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে আছে। ট্রায়াল শেষ হয়ে বাজারে আসতে টিকাগুলোর সময় লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রায়াল শেষ করে অনুমোদন পেতে যেকোনো টিকারই ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগতে পারে; যদি খুব দ্রুতগতিতে সবকিছু সম্পন্ন হয়। কখনো কখনো ১০ বছরও লাগতে পারে। তবে সবাই আশা করছে কোভিড-১৯-এর টিকা শিগগির বাজারে আসবে। যত দ্রুত টিকা আসবে, ততই মঙ্গল। এখন আমাদের দিন যায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা গুনে গুনে।

এখন পর্যন্ত টিকা তৈরির কাজে সব থেকে এগিয়ে আছে ব্রিটেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। তিন দেশের টিকাই ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে আছে। হুট করেই রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে, অক্টোবরেই মানবদেহে টিকার প্রয়োগ শুরু করবে তারা। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইতিমধ্যেই টিকা আবিষ্কার করে মানবদেহে প্রয়োগ করেছে। এর ফলাফলও নাকি ভালো মিলছে। উৎপাদনে যাবে অচিরেই। চীনও টিকার কাজে অনেকটাই এগিয়েছে বলে দাবি করছে। তারাও বাজারে আসি আসি করছে। কিন্তু ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আবার কিছুটা হতাশার কথাই শুনিয়েছে। সংস্থাটির প্রধানের মতে, টিকার দেখা আদৌ না-ও মিলতে পারে। এত যে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিয়ে হু নিজেই সন্দিহান। ধরা যাক টিকা আবিষ্কারের সব পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু তাই বলে জীবন বা গবেষণা কিছুই থেমে থেকে থাকবে না। নতুন নতুন টিকা আবিষ্কারে নিয়োজিত থাকবেন গবেষকেরা।

এই আশা-নিরাশার মধ্যেই টিকার রাজনীতি জমজমাট আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ যুগান্তকারী আবিষ্কারে পশ্চিমারাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এখন অবশ্য পূর্ব-পশ্চিম বলা হয় না, উত্তর-দক্ষিণে বিভাজিত করা হয়। উত্তরই একসময় সবকিছুর নিয়ন্তা ছিল। এখন দক্ষিণও উত্তরের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের টিকার সঙ্গে চীনের টিকার কথাও বেশ জোরেশোরেই আলোচনায় থাকছে। চীনে এখন সামাজিক সংক্রমণ হচ্ছে না। তাই সামাজিক সংক্রমণ আছে এমন কোনো দেশে চীন ট্রায়ালের জন্য টিকা দিতে চাইছে। ইতিমধ্যে আফ্রিকায় চীনা টিকার ট্রায়াল হচ্ছে। আমাদের দেশেও হওয়ার কথা ছিল। আইসিডিডিআরবি চীনে থেকে টীকা এনে ট্রায়ালে প্রয়োগের অনুমোদন পেয়েছিল। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরও আইসিডিডিআরবিকে আটকে দেওয়া হচ্ছে খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে। যেমনটা করা হয়েছিল গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে। চীনা টিকার ট্রায়াল নিয়ে টালবাহানার মধ্যে অনেকেই ভূরাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন।

অক্সফোর্ডের টিকা উৎপাদন করবে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের পুনে সিরাম ইনস্টিটিউট। এই টিকার ট্রায়ালের কথাবার্তাও চলছে। পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের অন্যতম বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের অর্ধেক টিকা এরা উৎপাদন করে। বাংলাদেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন, চীনের টিকার ট্রায়াল হবে, না অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়াল হবে। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী। নানা কারণেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। আবার সরকারের সঙ্গে বিশেষ সখ্যও রয়েছে। ওদিকে চীন অন্যতম বড় উন্নয়ন অংশীদার। ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে তাদের বাংলাদেশে। পদ্মা সেতু নির্মাণের অন্যতম বড় অংশীদার চীন। আরও চীনা বিনিয়োগ আসতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ টিকার রাজনীতির প্যাঁচে পড়েছে।

ধরা যাক দেশে চীনা ও অক্সফোর্ডের টিকার ট্রায়াল সফল হলো। তখন বাংলাদেশকে দুই দেশ থেকেই টিকা নিতে হতে পারে। এক দেশ থেকে নিলে অন্য দেশ গোসসা করতে পারে। তাই টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকার মজুত গড়ে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথা বলছে। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজেশনের মাধ্যমে দরিদ্র ও গরিবদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা চলছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে গেছে। এ কারণে হু কার্যকারিতা হারাতে পারে।

টিকার মালিক দেশগুলো নিজস্ব বলয়ের দেশে টিকা প্রথমে দিতে চাইবে। টিকা রাজনীতির একদিকে আছে মুনাফার হাতছানি, আরেক দিকে বাজার দখল করে নির্ভরশীল করার রাজনীতি। স্বল্প মূল্যে টিকা দিয়ে বড় বড় বাণিজ্যিক চুক্তি হাতিয়ে নিতে পারে টিকার মালিক দেশগুলো। চীন এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। যেসব দেশে চীনের বিনিয়োগ আছে, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার সুবিধা দিতে পারে চীন। এতে করে অন্যরা চীনের প্রতি আকৃষ্ট হবে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বিপরীত পক্ষের দেশগুলো যেন টিকা না পায়। টিকার অভাবে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। টিকার সংকট সৃষ্টি করে অপছন্দের দেশগুলোতে সরকারও নাড়িয়ে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যেই টিকা নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য অভিযোগ করেছে, রাশিয়া টিকার তথ্য চুরি করেছে। সম্প্রতি হ্যাকিংয়ে রাশিয়া সবার ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাকিং করে তথ্য পাচারের অভিযোগ উঠেছিল। বিস্ময়কর হচ্ছে, যুক্তরাজ্য হ্যাকিংয়ের অভিযোগ করার পরপরই রাশিয়ার টিকা গবেষণায় বেশ অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।

তবে একাধিক টিকা আবিষ্কার হলে সুবিধা। এই মুহূর্তে কমপক্ষে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডোজ টিকার উৎপাদন করতে হবে। তাই একাধিক দেশে একাধিক টিকার উৎপাদন করা প্রয়োজন। অন্যথায় টিকার সংকট দেখা দেবে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলো টিকার মজুত গড়ে তুলতে পারে। ৬৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য যুক্তরাজ্য ১০০ মিলিয়ন টিকার আগাম বুকিং দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনীতির শিকার হতে পারে দরিদ্র দেশগুলো। টিকার অনুমোদন নিয়েও দেশগুলোর মধ্যে রাজনীতির সূত্রপাত হতে পারে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি ওষুধের অনুমোদন দিয়ে থাকে। সবার আগে যদি রাশিয়া বা চীন টিকা আবিষ্কার করে ফেলে, তবে এই দুই এজেন্সি অনুমোদন দেবে কি না বা সময়ক্ষেপণ করবে কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ আছে।

একটি কথা এখন হরহামেশাই বলা হয়, পৃথিবীর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র স্থানান্তরিত হচ্ছে। দক্ষিণের ক্ষমতায়ন হচ্ছে। শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়াচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর অর্থনীতি। শেষ পর্যন্ত চীনের টিকা যদি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অনুমোদন লাভ করে, তবে একধরনের টিকাযুদ্ধ আমরা প্রত্যক্ষ করব। বিনিয়োগের নামে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ চীন নিয়েছে। কোভিড-১৯-এর টিকা ব্যবহার করে চীন আরও কিছু দেশের বাজার দখল করতে পারে। যদি তা-ই হয়, তবে তা হবে উত্তরের দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আরও দক্ষিণে কিছুটা সরে আসবে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।