বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

অন্য প্রায় সব বিকাশমান অর্থনীতির মতো বাংলাদেশেও উন্নয়নসহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলা অনেক দিন ধরেই একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত।

অনেক বছর ধরেই আমাদের আরও বৃহত্তর পরিসরে বিশ্বপরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হতে হচ্ছে। একই সঙ্গে তৈরি হতে হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগের উপযুক্ত গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় প্রচুর বেড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ পরিবহন যোগাযোগও বেড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডার বা অন্যান্য উন্নয়নসহযোগী, বেসরকারি খাত, বিদেশি বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান—সবাই বলছে, বাংলাদেশ যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে নিতে চায়, তবে অবকাঠামোগতভাবে আরও অনেক এগোতে হবে।

এই অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে যেমন রয়েছে রাস্তাঘাট, সেতু, তেমনি রয়েছে পাওয়ার প্ল্যান্ট, গ্যাসলাইন, ট্রাক–লরি বা যন্ত্রপাতি, আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন বা অভ্যন্তরীণ সরবরাহ চেইন উন্নয়ন ইত্যাদি। এখানে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানির জিআইজেডসহ অনেকেই অবকাঠামো নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে এবং কাজ করবে। আমাদের এখানে আরও বড় বড় সেতুর প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর আরও উন্নত করার। এ ছাড়া পায়রা বন্দরও দ্রুত প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা জানি, সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১০টি ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্প নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের অদূরে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (যেটি নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে), পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর নিচ দিয়ে টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি।

যেহেতু পেশাগত জীবনের প্রায় পুরোটাই অর্থায়নের কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম, অর্থায়ন করতে গিয়ে বড় বড় প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব–সংক্রান্ত কাজে জড়িয়ে আমার বৃহৎ প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারণা হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণ, প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকা, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যে আকাঙ্ক্ষা করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে কি না, জনগণ প্রকল্পের সুফল পেয়েছে কি না, সরকার–দাতাগোষ্ঠীর লক্ষ্য পূরণ হয়েছে কি না—দূর থেকে এগুলো পর্যালোচনা করার সুযোগ আমার হয়েছিল।

শুরুতেই বঙ্গবন্ধু সেতু বা যমুনা সেতু নিয়ে কথা বলতে চাই। এ সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশে যেকোনো নদীর ওপর সেতু করতে গেলে—নদীশাসন। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সময়ের সঙ্গে গতিপথ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। তাই নদীশাসন যমুনা সেতুর জন্য বিরাট একটা সমস্যা ছিল। দ্বিতীয় হচ্ছে মূল সেতু তৈরি, তৃতীয় অ্যাপ্রোচ রোড, চতুর্থ এ সেতু নির্মাণের পর যে একটা গ্রুপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং পঞ্চম এটিকে জনগণের সেতুতে রূপান্তর করা। বড় প্রকল্পগুলোর সবগুলোরই প্রায় একই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে আমরা অনেক শিক্ষা নিয়েছি। এ সেতু করার আগে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা সহজ ছিল না। যোগাযোগ অসুবিধার কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম পেতেন না। নামমাত্র দামে তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে হতো। সহজে তাঁরা ঢাকায় পণ্য পাঠাতে পারতেন না। পরিবহনের সমস্যার জন্য অনেক কৃষক দুঃখ-কষ্টে টমেটো, আলু, বেগুনের মতো ফসল জমিতেই নষ্ট করে দিতেন। পর্যালোচকেরা দেখলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু হলে কৃষকের মুখে হাসি ফুটবে। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন যুক্ত হয়ে সুবিধা বেড়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা এখন নেই বললেই চলে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে যোগাযোগ কাজ করেছে। কৃষকেরাও উপকার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সেতু বাস্তবায়ন আমাদের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অভিজ্ঞতা দিয়েছে। একই সঙ্গে এর সঙ্গে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল, বিশেষ করে সোনালী ব্যাংক, তাদের এ–সম্পর্কিত জ্ঞান বেড়েছে। পণ্য সরবরাহব্যবস্থা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহায়তার বিবেচনায় শুরুতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন কম থাকলেও পরে তা বেড়ে যায়।

কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড বা কাফকো প্রকল্পের সিন্ডিকেশনের সঙ্গে জড়িত ছিল আমাদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান সিটিব্যাংক এনএ। সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম বিদেশি মুদ্রার সিন্ডিকেশন হয়েছে কাফকোর অর্থায়নে। অনেকে হয়তো জানেন না, সেখানে অংশগ্রহণ করেছিল সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। এর ফলে এসব ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এ–সংক্রান্ত সম্যক ধারণা হয়েছে। তৎকালীন বিসিআইসির প্রথম প্রধান অর্থ কর্মকর্তা এবং পরবর্তীকালে চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন এ ক্ষেত্রে বেশ ইন্টেলেকচুয়াল সাপোর্ট দিয়েছিলেন। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল জাপানের চিয়োদা করপোরেশন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দাতাগোষ্ঠী, বাংলাদেশের প্রকৌশলী, অর্থ কর্মকর্তা ও অ্যাকাউন্ট্যান্টদের নিয়ে এ ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। উদ্ভূত বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে কাফকো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে প্রচুর মানুষ উপকৃত হয়েছে। কাফকোর সার একদিকে যেমন কৃষকদের উপকৃত করেছে, তেমনি রপ্তানি বাজারেও আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

যে দুটি প্রকল্পের কথা না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে মেঘনা সেতু ও গোমতী সেতু। এ সেতুগুলো এখন আমাদের লাইফলাইন হিসেবে কাজ করছে। এ সেতুগুলোর বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিল জাপানের ওবাইসি করপোরেশন। তারা অনেক ভালো কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ করে।

ভৈরব সেতু দেশের প্রথম এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টির (ইসিজি) বিপরীতে অর্থায়িত সেতু। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এডমান্ড নাটালের বিবেচনায় বিলেতের এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি ডিপার্টমেন্টের (ইসিজিডি) গ্যারান্টির বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এতে অর্থায়ন করে। এ সেতুটি বিনির্মাণে অর্থায়নের কাঠামোগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে যেমনটা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক জড়িত ছিল, তেমনটি তৎকালীন অর্থসচিব আকবর আলি খানের কথা না বললেই নয়। ইসিজিডি গ্যারান্টি আসতে পারে কি না, সেটা নিশ্চিত করা হলে কান্ট্রি রিক্স অনেক সময় জিরো হয়ে যায়, যার ফলে অনেক অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান অল্প সুদে ঋণ দিতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণও দেয়।

আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো এইএস মেঘনাঘাট এবং এইএস হরিপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আগের সময়ে (১৯৯৬-২০০১) একটি অত্যন্ত ভালো পাওয়ার পার্চেজ পলিসি হয়েছিল, যাকে বলে পিপিএ বা পাওয়ার পার্চেজ অ্যাগ্রিমেন্ট। তৎকালীন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি অত্যন্ত আধুনিক ও যুগান্তকারী কাজ করেছিল। মেঘনাঘাট ও হরিপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে দ্রুত সময়ে জনগণের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। যার জন্য তারা ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের পুরস্কারও পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি বিশ্বের কোথাও এত কম দামে বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। এ জন্য যেমন পিপিএ অবদান রেখেছে, তেমনি সরকারের সময়মতো গ্যাস সরবরাহ করতে পারাও বড় ভূমিকা রেখেছে। আর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত সরকারের ইডকল মহিরুহ ভূমিকা পালন করেছে।

এ প্রকল্প করতে গিয়ে আমরা পরিচিত হলাম পলিটিক্যাল রিস্ক ইনস্যুরেন্সের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান বলেছিল, আমরা যদি পলিটিক্যাল রিস্ক ইনস্যুরেন্স কভারেজের মাধ্যমে রাজনৈতিক ঝুঁকিটাকে শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি, অথবা কান্ট্রি রিস্ক হংকং কিংবা বাহরাইনের সমান করা যায়, তবে তারা আরও কম সুদে বা দামে এইএস মেঘনাঘাট এবং এইএস হরিপুরে অর্থায়ন করতে পারবে। পরে এটি করা হয়।

আমরা ভৈরব সেতু করতে গিয়ে শিখলাম ইসিজি। বঙ্গবন্ধু সেতু করতে গিয়ে ইন্টারনাল রেট অব রিটার্নের কথা চিন্তা করতে শিখলাম। এ সেতুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো শিখলাম। সরকারি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতার গুরুত্ব বুঝলাম। গোমতী ও মেঘনা সেতু করতে গিয়ে শিখলাম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব।

লাফার্জ-সুরমা সিমেন্ট প্রকল্প করার সময় ঠিক হয় এটি হবে সিলেটে এবং এর কাঁচামাল আসবে ভারত থেকে। এটা ছিল ট্রাই-নেশন প্রজেক্ট। কিন্তু মেঘালয়ে পরবর্তীকালে এ নিয়ে জনস্বার্থে মামলা হয়। এ প্রকল্পের জন্য চুনাপাথর তোলার ফলে খনি এলাকার জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব দেখা যাচ্ছিল। যেহেতু প্রকল্পটি ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস হয়েছিল, তাই এ জনহিতকর মামলার বিবাদী হলো ভারত সরকার। ওই সময় ভারতের আদালতে চুয়াত্তরের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়েছিল।

ব্যর্থ প্রকল্পের কথা বলতে গেলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এটিপি কেনাটা আগে আসে। এগুলো চালানো গেল না, তাই আকাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই এগুলোকে ডিকমিশন করতে হয়েছে, বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তবে এয়ারবাস প্রকিউরমেন্ট অনেক ভালোভাবে হয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিটি বড় প্রকল্পের পেছনে অভিনবত্ব থাকে, সরকারি কর্মকর্তা, অর্থ বিশেষজ্ঞ, বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবদান থাকে। যদি আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, ফয়জুল কবির খান না থাকতেন, তবে বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভবত অনেক দেরি হতো। আরেকজনের কথা না বললেই নয়। যে সরকারই থাকুক না কেন, যিনি প্রায় সব বড় প্রকল্পে নিরলসভাবে সহায়তা করে গিয়েছেন, তিনি হলেন প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। সেই সঙ্গে অনেক প্রকল্পে অধ্যাপক আইনুন নিশাতের নামও এসে যায়।

সরকারের হাতে এখন যে বড় বড় প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, পদ্মা সেতু, রূপপুর আণবিক শক্তি কেন্দ্র প্রভৃতি। এগুলোর বাস্তবায়নে আমাদের প্রয়োজন সক্রিয় সরকারি কর্মকর্তা, বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও প্রকৌশলী। প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা যাতে ভালো হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সরকারকে জিম্মি করে বা দুর্নীতি করে বিদেশে বেশি অর্থ নিয়ে যেতে না পারে, কাজ ঠিকমতো যেন হয়, তার জন্য মনিটরিংটা ঠিকভাবে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতো আলাদা করে প্রকল্প উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

আগের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন ব্যক্তি বড় ভূমিকা রেখেছেন। একই ধারায় বর্তমানের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে, জ্ঞানীগুণী এবং কর্মে দক্ষ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

এখন প্রকল্প ব্যয় ঠিক থাকে না, প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়, প্রকল্প ঘিরে অনেক দুর্নীতির কথা শোনা যায়। যেমন পদ্মা সেতুর ব্যয় বেড়েই চলেছে। আমরা মনে করি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও বেশি শৃঙ্খলা আনা উচিত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেন সরকারকে জিম্মি করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশের যেসব কনট্রাক্ট প্রতিষ্ঠান থাকবে, সেসব নিয়োগ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা যেন প্রাধান্য না পায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

প্রকল্পে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে সহায়তা করবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল রিস্ক ইনস্যুরেন্স, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা ইউএস এক্সিম ব্যাংককে এখানে এনেছিলাম। ইআরডির কিছু কর্তাব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ওপিকের গ্যারান্টি এনেছিলাম। খুলনা পাওয়ার কোম্পানি বাস্তবায়নের সময় ওপিক গ্যারান্টি দিয়েছিল, যেহেতু মার্কিন প্রতিষ্ঠান এলপাসো এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এনএপিসি পাওয়ার কনসোর্টিয়ামে ওপিক গ্যারান্টির কারণে অর্থায়ন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল।

বিমানের বোয়িং এয়ারক্রাফট আনার কাজ সহজ হয়ে গিয়েছিল, কারণ ম্যাচিং গ্যারান্টি বাংলাদেশে কার্যরত কিছু ব্যাংককে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এতে ব্যাংকের সক্ষমতা বেড়েছিল, ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করতে পেরেছে, কিছু আয় করতে পেরেছে, ব্যাংকগুলোর বিমানের কাছ থেকে কিছু ডিপোজিট পেয়েছে, ইউএস এক্সিম ও ওপিকের গ্যারান্টির কারণে টাকা তোলা সহজ হয়েছিল। রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড বা ভেল যেহেতু এটার বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে, তাই ভারতের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়নে সহায়তা করতে রাজি হয়েছে। এ কারণে অর্থায়নও কিছুটা সহজ হয়েছে।

পলিটিক্যাল রিস্ক ইনস্যুরেন্স, ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন, সামাজিক, পরিবেশ, অর্থনৈতিক, জনগণের উপকার, দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়গুলো যখন আনা হয়, তখন অর্থায়ন অনেক সহজ হয়ে যায়। পরিবেশগত বেশি বিপত্তি ঘটানো প্রকল্পে এখন অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে তারা আর অর্থায়ন করবে না। ব্রিটেন ও ইউরোপের অনেক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান বলছে তারাও আর এ ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। এভাবে পরিবেশদূষণ বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিরাট ব্যাপার হয়ে উঠছে।

রূপপুর আণবিক শক্তিকেন্দ্র রাশিয়া করছে। কিন্তু এ প্রকল্পের ব্যয় কী হবে, তা নিয়ে আমাদের ধারণা নেই। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি প্রতিষ্ঠান, অথবা যেসব প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারত বা এখনো সম্ভব।

পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়, প্রকল্পের ব্যয় ধীরে ধীরে যেন বেড়ে না যায়, দুর্নীতি যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন করলে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অন্য প্রকল্পের ক্ষতি না হয়।

আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান যখন আসে, তখন প্রকল্পের সুশাসন নিশ্চিত হয় বেশি। তখন আন্তর্জাতিক ভালো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আসতে চায় কারণ তারা মনে করে বিশ্বব্যাংক বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকলে তাদের অর্থ পেতে বেশি দেরি হবে না, কোনো বিতর্ক তৈরি হবে না। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের পরেও তাদের নিয়ে টানাহেঁচড়া হবে না, মামলা হবে না, কারণ বিশ্বব্যাংকের নিযুক্ত আইনজীবীরাই বলে দেবেন তারা কাজ করতে পেরেছে কি পারেনি।

আমরা মনে করি বর্তমান প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশজ মেধাকে সম্পৃক্ত করা, রিটার্ন যেন খুব ভালো হয় তা পর্যালোচনা করা, পরিবেশগত প্রভাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া, দক্ষ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সড়ক ও রেলপথ বিভাগের ভালো প্রকৌশলীদের অন্তর্ভুক্ত করা, ভালো ভালো হিসাব প্রতিষ্ঠান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্প খুব একটা বেশি এগোতে পারেনি, পারবেও না।

মামুন রশীদ, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক