করোনাকাল নাগরিক উদ্যোগের কালও বটে

জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী তরুণেরা। ময়মনসিংহ। ছবি: সংগৃহীত
জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী তরুণেরা। ময়মনসিংহ। ছবি: সংগৃহীত

ইদানীং আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের কিছু বড়সড় উন্মুক্ত পার্কে এবং নদীতটে একটি নতুন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বড় বড় পাথরের গায়ে জীবনবাদী গানের কথা, স্লোগান ইত্যাদি লেখা রয়েছে। কে বা কারা লিখেছে কেউ জানে না। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ সকালে-বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দেখছেন সেসব আশার বাণী। যেমন ‘গা পোড়ানো রোদের দিন আসলে ভালো দিন’। আরও লেখা ‘যখন তুমি বড় পাথরকে গড়িয়ে আসতে দেখো, সেটি তোমাকে আহত করতে পারবে না’, ‘তোমার যা কিছু চাওয়া তা ভয়ের উল্টো পিঠেই আছে’ ইত্যাদি। করোনাকালে মানুষের মনোবল চাঙা রাখার জন্য নাগরিক শিল্পীরা স্বেচ্ছায় পাথরে লিখে চলেছেন এসব বাণী।

কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় স্যালমন আর্ম নামে একটি বিশাল গ্রাম আছে। সেই গ্রামে সুস্বাপ আদিবাসীদের বাস। নিকোল ডেফেও নামে একজন সুস্বাপ নারী অসংখ্য নোটবই কিনে শৈল্পিক কারুকাজসহ উদ্দীপনামূলক উক্তি লিখে বিনে পয়সায় বিলি করে চলেছেন মানুষের মাঝে। আরেকজন নামকরা সুস্বাপ মৃৎশিল্পী ব্রুস ন্যস্তে বিশেষ কারুকাজখচিত বড় আকারের মাটির বাটি বিনে পয়সায় দান করে চলেছেন। সেগুলো বিক্রির অর্থের পুরোটাই দরিদ্র করোনা রোগীদের জন্য খাবার সংগ্রহশালায় জমা হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে নাগরিকেরা প্রতিদিনই এ রকম শত শত উদ্যোগ নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীভিত্তিক এসব উদ্যোগের সবই স্বেচ্ছাসেবামূলক। নাগরিক উদ্যোগগুলো মূলত তাৎক্ষণিক ও সাময়িক। এনজিও বা আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর নিয়মিত কর্মসূচির সঙ্গে এগুলোর সংস্রব নেই। ছোটখাটো ব্যক্তি-উদ্যোগের বাইরে বড়সড় নাগরিক উদ্যোগও বাড়ছে। নাগরিক উদ্যোগে বিশ্বজুড়ে কয়েক লাখ ফুডব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্য গ্লোবাল ফুড ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক নামের সংস্থাটি ৪০টিরও বেশি দেশের নাগরিক উদ্যোগকে কার্যকর রাখতে সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি ১০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহে নেমেছে। ‘ক্রু নেশন’ প্রকল্প পেপ্যালের মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করছে।

‘গ্লোবাল সিটিজেন্স’ নামে একটি সংস্থা জন্ম নিয়েছে। সংস্থাটি ‘একটিই বিশ্ব’ নাম নিয়ে লেডি গাগার আট ঘণ্টার সরাসরি সংগীতের লাইভস্ট্রিম আয়োজন করে। লেডি গাগা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রযোজিত আয়োজনটির সংগ্রহ ১২৮ মিলিয়ন ডলার। সংগৃহীত অর্থ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে অসচ্ছল করোনা-বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার কাজে ব্যবহৃত হবে। গায়ক এল্টন জনও সংগ্রহ করেছেন ৮ মিলিয়ন ডলার। গায়িকা রিহানার ক্লারা লিওনেল ফাউন্ডেশন এবং জ্যে-জেডের শ’ কার্টার ফাউন্ডেশনের সম্মিলিত সংগ্রহও আরও ৮ মিলিয়ন ডলার।

নাগরিকেরা এই সুযোগে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত ও লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্যগুলোর উদ্যোক্তা ও মালিকদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। এখনো সক্রিয় অনেকেই। উদ্দেশ্য ‘করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ বা ‘বাণিজ্য সংস্থার সামাজিক দায়িত্ব’ পালনে যতভাবে সম্ভব অনুপ্রাণিত করা। গায়ক-গায়িকা বা চলচ্চিত্রজগতের মানুষদের দাতব্য-সামর্থ্য বরাবরই বেশি। কিন্তু ঘরে বসে লাইভ অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতে পারার ব্যবস্থা করার অভিনব ভাবনাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেছে নাগরিক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমেই।

নাগরিক উদ্যোগের আরেকটি সাফল্যের দিক ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ বা ‘সিটিজেন্স জার্নালিজম’। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি তথ্য ব্যবস্থাপনা খটমটে ধরনের। দুনিয়াজুড়েই আমলাতান্ত্রিক তথ্যপ্রবাহে নাগরিকদের আস্থা কমছে। নাগরিক তাঁর আশপাশের জীবনযাপনের সংকট যতটা কাছে হতে দেখেন, রাষ্ট্র ততটা সংবেদন নিয়ে দেখে না। করোনাকালে খোদ মার্কিনরা এই অনুভূতিই ব্যক্ত করছেন। চীন, ইরান, ব্রাজিল, উত্তর কোরিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশের নাগরিকেরাও তথ্য ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট নন। প্রচারিত তথ্যে তাঁদের আস্থা কম। সারা বিশ্বেই নাগরিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ যতটা সম্ভব জরুরি তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনের চেষ্টায় স্বনিয়োজিত রয়েছে।

চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশের কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং তথ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও অনেক নাগরিক ঝুঁকি নিয়ে সিটিজেন জার্নালিজমে অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে সরকারি তথ্যপ্রবাহের সমালোচনাও বাড়ছে। ফলে গ্রেপ্তারও বাড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অন্তত পাঁচজন সিটিজেন জার্নালিস্টের মুক্তির জন্য বিশ্ব মতামত তৈরি করছে। এই পাঁচজন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বাস্তব অবস্থাটি সরেজমিন প্রচার করার ঝুঁকি নিয়েছিল। টার্মিনাস-২০৪৯ চীনের নাগরিক সাংবাদিকদের প্রকাশনা সাইট। গিটহাব নামের উন্মুক্ত সোর্স কোড বিনিময় ও প্রকাশকারী সার্ভারের অধীনে টার্মিনাস-২০৪৯ সাইটটি পরিচালিত হয়। চীনা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এড়াতেই নাগরিক সাংবাদিকেরা এই সাইটে জড়ো হয়।

আল-জাজিরা তাদের নামকরণ করেছে ‘করোনা কমিউনিকেটরস’ বা ‘করোনা তথ্য নিময়কারীগণ’। তাদের কাজকর্মের নাম দিয়েছে ‘প্যান্ডেমিক জার্নালিজম’ বা ‘অতিমারি সাংবাদিকতা’। বিশ্বের চারটি প্রধান নাগরিক সাংবাদিকতাকে উপজীব্য করে আল-জাজিরা ‘দ্য লিসেনিং পোস্ট’ নামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের মূল ভাষ্য ছিল এই যে খবরের গভীরের খবর এবং করোনা-সম্পর্কিত জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলো বিশ্লেষণে নাগরিক সাংবাদিকতা অনন্য ভূমিকা রাখছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক ‘ইম্প্যাক্ট-ড্রিভেন জার্নালিজম’ বা ‘কার্যকারিতামুখী সাংবাদিকতা’ প্রত্যয়টি ব্যবহারের দ্বারা স্বীকার করে নিয়েছে যে নাগরিকের সংবাদ ব্যবস্থাপনার অসাধারণ কার্যকারিতা রয়েছে।

করোনা সংকটের শুরুর দিকে সমাজবিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুনছিলেন। কারণ, অসংখ্য। পশ্চিমের দেশগুলোতে চীনা অভিবাসীরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। নব্য বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। রোগটি সম্পর্কিত এক তথ্যের সঙ্গে আরেক তথ্যের পারম্পর্য ছিল না। ফলে নাগরিকেরা ছিল বিভ্রান্ত। স্বাস্থ্য আচরণবিধি নিয়েও একেকবার একেক কথা শোনা যাচ্ছিল। এইডস চিহ্নিত হওয়ার প্রথম বছরে মানুষের মধ্যে যে রকম ভীতি ও ‘স্টিগমা’ দেখা গিয়েছিল, করোনাকালেও সে রকম ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। গণমাধ্যম মানুষের অমানবিকতার নতুন নতুন দিকের উন্মোচন ঘটাচ্ছিল। গৃহসদস্যরা করোনায় আক্রান্ত সদস্যদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে ফেলে পালিয়েছে।

পশ্চিমে সামাজিক জীবন বহির্মুখী। ক্লাব-বার-পাবনির্ভর। সেখানে গৃহবন্দিত্ব হতাশা ও বিষাদ-অবসাদে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। গণমাধ্যমে এসব দুর্ঘটনার খবর গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে গণভীতি বিপজ্জনক রূপ নিয়েছিল। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা রকম প্রতারণা ও অপরাধ। বাংলাদেশে সাহেদ-সাবরিনাকাণ্ডের মতো অপরাধের ও প্রতারণার ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কমবেশি ঘটেছে

বার্নি স্যান্ডার্সের একটি বিখ্যাত উক্তি ‘কঠিন সংকটকালেই সাধারণত মানুষের ভালো দিকগুলোর প্রকাশ ঘটে’। করোনাকালেও কথাটির সত্যতা মিলছে। গত কয়েক মাসের করোনায় আক্রান্ত সময়টি শুধুই আতঙ্কের ও হতাশার নয়। ভীতি কাটিয়ে ওঠারও সময়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ ধারণাটি সঠিক প্রমাণিত হওয়ারও সময়। এই বছরের মে মাসের ৪ তারিখের নাগরিক উদ্যোগের অনুপ্রেরণায় ২৮ মে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘করোনাভাইরাস বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া’র (করোনাভাইরাস গ্লোবাল রেসপন্স) পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে। ‘বৈশ্বিক নাগরিক’ বা ‘গ্লোবাল সিটিজেন্স’ নামের জন–উদ্যোগ-প্রচারণা (অ্যাডভোকেসি) প্রকল্পটিই ছিল সেই কর্মসূচি। তার ভিত্তিতেই ২৭ জুন ‘বৈশ্বিক লক্ষ্য: ভবিষ্যতের জন্য একাত্ম হও’ (গ্লোবাল গোল: ইউনাইট ফর আওয়ার ফিউচার) শিরোনামের সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সব নাগরিক উদ্যোগের প্রতি বিশ্বসমাজের অকুণ্ঠ সহযোগিতা-সমর্থন দরকার—এই আবেদনই ছিল সম্মেলনটির মূল চাওয়া।

২০২০ সালের শুরুতেই ‘উই দ্য পিপল’ নামের একটি বৈশ্বিক নাগরিক উদ্যোগ ‘আ ভয়েস ফর গ্লোবাল সিটিজেন্স’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে জাতিসংঘের কাছে দাবি জানানো হয় যেন জাতিসংঘ অবশ্যই নাগরিক উদ্যোগগুলোকে সহায়তা ও স্বীকৃতি দেয়। প্রস্তাব রাখা হয় যেন জাতিসংঘ অনতিবিলম্বে বৈশ্বিক নাগরিক উদ্যোগের কলাকৌশল (ইনস্ট্রুমেন্ট অব আ ওয়ার্ল্ড সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভ–ডব্লিউসিআই) নির্ধারণ করে। কারণ, এটি সময়ের দাবি। এই দাবি বাস্তব। ইউরোপীয় নাগরিক উদ্যোগগুলোর (ইউরোপিয়ান সিটিজেন্স ইনিশিয়েটিভস) সাফল্যই তার প্রমাণ।

এই উদ্যোগে অংশ নেওয়া নাগরিকেরা নির্বাচিত প্রতিনিধি না হয়েও ইউরোপীয় কমিশনে বিভিন্ন জনবান্ধব আইন তৈরির প্রস্তাব করতে পারে। এই উদাহরণ বিবেচনায় নিয়েও জাতিসংঘ সনদের ২২ অনুচ্ছেদের অধীনে ডব্লিউসিআই কলাকৌশল নির্ধারণ করা সম্ভব। ২২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রতি ১০টি সদস্যদেশের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ জনসংখ্যার সমর্থন থাকলে অথবা কোনো পিটিশনের বিপরীতে ৫০ লাখ নাগরিকের স্বাক্ষর থাকলেই নাগরিক উদ্যোগকে জাতিসংঘের একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ (সাবসিডিয়ারি অর্গান) ঘোষণা করা যায়। সাবেক মহাসচিব কফি আনান কিন্তু ২০০২ সালের ‘টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষ সম্মেলনেই নাগরিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাকে অশেষ গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন।

করোনাকালে বিশ্বজুড়েই নাগরিক উদ্যোগ বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন আশাপ্রদ তথ্য মিলছে। এসব তথ্য একটি ইতিবাচক ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। করোনার পর অন্য কোনো রোগশোক, মারি-অতিমারি বা দুর্যোগ-সংকটেও মানুষ যে ভেঙে পড়বে না—করোনা সেই সত্যেরও উন্মোচন ঘটিয়েছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে নাগরিক উদ্যোগের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলা এখন প্রয়োজন।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক ও গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।