ভ্রাম্যমাণ শিল্পীদের দুর্দিন

যে মানুষদের আয়ের উৎস ছিল পথ, পেশা ছিল ভ্রাম্যমাণ, জানা ছিল গান—মহামারি তাঁদের প্রাণে যদি মেরে না থাকে, তবে পেটে মেরেছে। কোথায় সেই সব হাটবাজারের ভিড়, কোথায় চায়ের দোকানের হঠাৎ জলসা। সব স্তিমিত হয়ে আছে। এর মধ্যে আধভাঙা সাইকেল চালিয়ে দোতারা কাঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন পথগায়ক নুরুল ইসলাম (৫২)। কিন্তু শ্রোতা নেই, তাই টাকাও নেই, তাই রুটিরুজির জোগানও নেই। ক্ষুধা কখনো একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে অসুস্থতা ও বহুবিধ অশান্তি। যে মানুষটি গান ছাড়া আর কিছু জানেন না, যাঁর প্রাণের সুর সংগীতের তারে তারে বাঁধা, সেই মানুষটি এখন কী করবেন? প্রথম আলোর শনিবারের সংবাদে প্রকাশিত নুরুল ইসলাম একা নন, এ রকম হাজারো পথশিল্পী ও বাউল গায়ক-বাদকেরা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

শুধু কি গায়ক-বাদক? গ্রাম ও শহরে অজস্র মানুষ বিভিন্ন রকম ভ্রাম্যমাণ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কেউ হয়তো চুড়ি-ফিতা বিক্রি করেন, কেউবা জাদু দেখান, কেউবা সাপের খেলা দেখান, কেউ বিক্রি করেন ভেষজ ওষুধ। করোনার ভয়ে সামাজিক দূরত্ব মানা মানুষেরা তাঁদের মজমায় আসতে ভয় পাবেন, এটা স্বাভাবিক। আবার যে নিম্নবিত্তের মানুষেরা ছিলেন এঁদের পৃষ্ঠপোষক, তাঁদেরই তো আয়-রোজগারের ঠিক নেই। গরিবই গরিবের দুঃখ বোঝে, এ কথা ঠিক। কিন্তু গরিব যখন নিঃস্ব হয়, তখন অপরের দুঃখ বুঝলেও কিছু করার থাকে না।

ভ্রাম্যমাণ শিল্পী ও পেশাজীবীরা পথেই জীবিকা খুঁজলেও, তাঁরা এ সমাজেরই মানুষ। তাঁরা এই দেশের নাগরিক। যেখানে তাঁদের বাস, সেখানে সরকার-প্রশাসন আছে, স্থানীয় সরকার আছে। দুর্যোগের সময় প্রান্তিক মানুষদের সহায়তা করা তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সরকারও ত্রাণ ও প্রণোদনার আকারে বিস্তর সাহায্য দিয়েছে। যাঁরা এসব পাওয়ার যোগ্য, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের বদলে এসব ভোগ করে অন্য শ্রেণির লোক। দিনের শেষে এই সব নিঃসহায় মানুষ শূন্য হাতেই ঘরে ফেরেন।

ডিজিটাল প্রযুক্তি জনপ্রিয় হওয়ার পর প্রতিভাবান পথগায়কদের গান পথের জলসা ছাপিয়ে শহরে-নগরে এবং টেলিভিশনে শোনা যায়, ইউটিউবে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এসবের সুফল ভোগ করতে পারেন যে কেউই, কিন্তু সেই সব শিল্পী কোনো প্রতিদান পাবেন না, তা হয় না। প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমি রয়েছে, সরকার শিল্পীদের জন্যও দুর্যোগকালীন বরাদ্দ দিয়েছে। তা হলে নুরুল ইসলামের মতো গায়কেরা কেন দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে কষ্টে থাকবেন?