মেসভাড়া: খুলনার দৃষ্টান্ত সবাই মেনে চলুক

করোনাকালের শুরু থেকে একের পর এক মানবিক বিপর্যয়ের উদ্বেগজনক খবর আমরা শুনে এসেছি। অসুস্থ মাকে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া, বাবাকে হাসপাতালের বারান্দায় রেখে সন্তানের পালিয়ে যাওয়া কিংবা করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকারে স্বজনদের কাছে না পাওয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে। আবার করোনাকে পুঁজি করে সাহেদ করিম-আরিফুল-সাবরিনার মতো প্রতারকচক্রের দৌরাত্ম্যও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এর বিপরীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর সেবা করেছেন। যখন করোনারোগী মারা যাওয়ার পর স্বজনেরা তাঁকে দেখতে পর্যন্ত আসেননি, তখন নারায়ণগঞ্জে আলম খন্দকারের মতো বহু মানুষ তাঁদের সৎকারে এগিয়ে এসেছেন।

করোনাকালে স্বল্প আয়ের মানুষের আয়রোজগার প্রায় বন্ধ ছিল। এ কারণে অনেকে বাড়িভাড়া দিতে পারেননি। কোনো কোনো বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়া আদায়ে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন। কাঁঠালবাগানের এক বাড়িওয়ালা রাতের বেলা তাঁর ভাড়াটেকে বের করে দিলে বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। একই কাজ করেছেন আরেক বাড়িওয়ালা তাঁর ভাড়াটে শিক্ষার্থীদের প্রতি। করোনাকালে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। স্বাভাবিকভাবে শহরে তাঁদের বাড়ি বা মেসভাড়া বকেয়া পড়েছে। এই অবস্থায় কোনো কোনো বাড়িওয়ালা তাঁদের বইপত্র ও মূল্যবান সনদ বাইরে ফেলে দিয়ে কেবল অমানবিক আচরণই করেননি, ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। বাড়ি বা মেসভাড়া বকেয়ার জন্য কেউ কারও জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দিতে পারে না।

করোনাকালে যেসব শিক্ষার্থী বাড়ি বা মেস ভাড়া করে থাকতেন, তাঁরাই বেশি বিপদে পড়েছেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের নিজস্ব ছাত্রাবাস নেই। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ছাত্রাবাস আছে, তাতেও সব শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা নেই। অনেককে থাকতে হয় মেস বা বাড়ি ভাড়া করে। যেখানে ছাত্রাবাসে একজন ছাত্রকে মাসে ১০ টাকা ভাড়া দিতে হয়, সেখানে মেসভাড়া দিতে হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ছাত্রাবাস নেই। যে কয়টি ছিল, তাও প্রভাবশালীদের দখলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি নেই (খুব বেশি হলে ৫ শতাংশের ঢাকায় বাড়ি আছে, বাকি ৯৫ ভাগই ভাড়া বাড়ি বা মেসে থাকেন), তাঁদের সহায়তা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯টি ছাত্র ও সংস্কৃতি সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি। আরও আপত্তিকর হলো উপাচার্যের বক্তব্য। তিনি ছাত্রছাত্রীদের আবেদনের জবাবে বলেছেন, ‘আমি মনে হয় সবচেয়ে গরিবের বাচ্চাদের নিয়ে এসে ভর্তি করেছি।’ সহানুভূতি প্রকাশ তো দূরের কথা, পরিবার নিয়ে কথা তোলা চরম অশিষ্টতা। এটি একটি মন্দ নজির হয়ে থাকবে।

এ ক্ষেত্রে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। তারা বাড়িওয়ালা, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে একটি সমাধানে এসেছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা ক্যাম্পাস এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়া থাকেন, তাঁদের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িভাড়া ৩০ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার খুলনা জেলা প্রশাসন ও কুয়েট কর্তৃপক্ষের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই সুবিধা কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা পাবেন। এর পক্ষে যুক্তি হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ হলে আসন না পেয়ে মেসে থাকতে বাধ্য হন।

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন জানিয়েছেন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িভাড়া ৩০ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে যদি কুয়েট খুলে যায়, তাহলে খোলার পরবর্তী মাস পর্যন্ত এই সুবিধা বহাল থাকবে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসের ভাড়া বকেয়া পড়েছে। কুয়েট কর্তৃপক্ষ মালিকদের এই মানবিক আচরণে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

কুয়েটে সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকার ব্যবস্থা আছে অর্ধেকের। আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় সাত হাজার। সেখানেও অর্ধেক শিক্ষার্থী হলে থাকতে পারেন। বাকিদের বাইরে মেস বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। তবে কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করেন, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ নয়, ভাড়াটে সব শিক্ষার্থীকেই এই সুযোগ দেওয়া উচিত।

এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিত তাঁদের মেসভাড়া ৩০ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। সেখানে ভাড়া নিয়ে মালিকপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই পক্ষকে নিয়ে বসে এই সিদ্ধান্তে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল রোডসংলগ্ন ইসলামনগর ও খানজাহাননগর এলাকার বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা হয়। তবে শিক্ষার্থীদের দাবি, ৫৫ শতাংশ ভাড়া কমানো হোক। গত জুলাই মাসে একজন শিক্ষার্থী ভাড়া কমানোর দাবি করলে বাড়িওয়ালা তাঁকে মেস ছাড়তে বাধ্য করেন। এরপর ওই শিক্ষার্থী হরিণটানা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত হয়।

এই উদ্যোগগুলো ছোট; কিন্তু মহৎ। একজন বাড়িওয়ালার জন্য তিন বা ছয় মাসের জন্য ভাড়া কমালে তিনি আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হবেন না। খুলনার বাড়ির মালিকেরা ভাড়া কমিয়ে যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করব, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও যেসব বাড়িতে শিক্ষার্থীরা ভাড়া থাকেন, সেসব বাড়ির মালিকেরা অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেবেন। একজন বাড়ির মালিক তাঁর বাড়ি বা মেসভাড়া কমালে তাঁর আয় কমে গেলেও তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু করোনাকালের কয়েক মাসের মেস বা বাড়িভাড়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন জরিপে জানানো হয়েছে, করোনাকালে কেবল স্কুল পর্যায়ের নয়, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়েরও শিক্ষার্থীদেরও একাংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা আছে। বাড়িতে অভিভাবকেরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় যত কমই হোক, বাড়ি বা মেসভাড়া কমলে ওই শিক্ষার্থীদের বড় সাশ্রয় হবে।

প্রশ্ন হলো, খুলনার বাড়িওয়ালারা শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়িভাড়া ছাড় দিতে পারলে অন্যরা কেন পারবেন না? বাংলাদেশে মেস ভাড়া করে থাকেন, এ রকম শিক্ষার্থী হবেন লাখ লাখ। এ অবস্থায় তাঁরা কেবল বাড়িওয়ালার কাছে নয়, সরকার ও নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও সহায়তা পেতে পারে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, শিক্ষকেরা কিছু কিছু সহায়তা করছেনও। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সংগঠন হিসেবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের তাঁরা যে সহায়তা করছেন, সেটি হয়তো টাকার অঙ্কে বেশি নয়, কিন্তু ওই শিক্ষাব্রতীদের জন্য বড় পাওয়া। তাঁরা ভাববেন, তাঁদের দুঃসময়ে কেউ না কেউ পাশে আছেন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]