'বন্দুকযুদ্ধের' গল্পগুজব

কক্সবাজারের টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ যতই উন্মোচিত হচ্ছে, ততই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আদতে যে ‘সুসজ্জিত মিথ্যা’ এবং এর পক্ষে সাজানো যুক্তিগুলো যে গল্পগুজব, তা-ই প্রমাণিত হচ্ছে। এ ঘটনা দেশের মানুষের মনে বিপুল আলোড়ন, যন্ত্রণা ও ভীতি ছড়িয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে এর চিরতরে অবসান দাবি করেছেন। দাবিটা জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। আইন ও সংবিধান মানলে এই দাবিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

প্রথম আলোর সংবাদ জানায়, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে কেবল কক্সবাজার জেলাতেই ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। তাঁদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬২ জন ও র‌্যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। এর বেশির ভাগের সঙ্গেই মেজর রাশেদ হত্যায় অভিযুক্ত ওসি প্রদীপ গংয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা বাহিনীর একটি এলাকাতেই এত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা এক ভয়াবহ ব্যাপার। সরকারের দেওয়া অঘোষিত দায়মুক্তির জোরে সারা দেশেই এটা চলছে।

গত ২০ বছরের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাপঞ্জি প্রমাণ করে, অপরাধ দমনের নামে এটা কার্যত রাষ্ট্রের ‘নীতি’ হয়ে উঠেছে। নইলে লাগাতার ‘হত্যাকাণ্ড’ চালানোর পরও কাউকে পুরস্কৃত করা হয় কীভাবে? অথচ অপরাধ তো কমেইনি, বরং ভয়াবহতার নতুন নতুন শিখর তা ছুঁয়ে ফেলেছে। আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরে কোনো ‘ভালো’ ঘটতে পারে না। যাঁরা ‘ভালো ক্রসফায়ার’ চাইতেন, তাঁদের অনেকেও এখন এটা উপলব্ধি করছেন। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ থেকে শুরু করে ফিলিপাইনের অভিজ্ঞতা বলে, মাদক বা অপরাধ দমনের এই পন্থা পরিণামে অপরাধ তো কমায়ইনি, বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকেই আইনভঙ্গে উৎসাহিত করেছে, তাদের ভেতরে অপরাধমনস্কতা বাড়িয়েছে।

 কক্সবাজারের ঘটনায় পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আর এমনটি ঘটবে না। বিশেষ কোনো বাহিনীর বেলায় এটা ঘটবে না, নাকি সবার ক্ষেত্রেই কথাটা প্রযোজ্য, তা পরিষ্কার করা দরকার।

সব মৃত্যুই সমান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদের হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিয়েছে। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল মহলও সজাগ। কিন্তু টেকনাফের নিহত কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামুলের মতো অজস্র ভুক্তভোগীর পরিবার বুকের ভেতর স্বজন হারানোর শোক এবং বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। কেবল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেই কিছু নড়াচড়া হবে, মামুলিদের বেলায় প্রতিষ্ঠিত হবে সুসজ্জিত মিথ্যা এবং পরিকল্পিত অবিচার—এটা অগ্রহণযোগ্য।

‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’—যে নামেই ডাকা হোক, হত্যা হত্যাই এবং তা আইনের চূড়ান্ত বরখেলাপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন নিজেরাই বিচারক এবং নিজেরাই তার বাস্তবায়নকারী হন, তখন আইন-আদালত-মানবাধিকার এবং সংবিধান—সবকিছুই উপেক্ষিত হয়। ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ থেকে ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’—যে নামেই এসব চলুক, প্রতিটি বেআইনি হত্যা রাষ্ট্রশক্তিকে বেপরোয়া এবং আইনের হাতকে অসহায় অবস্থায় ফেলে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা এবং সম্প্রতি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ড সেই অন্ধকার ইতিহাসের একেকটি কলঙ্কিত সোপান। মেজর সিনহাকে হত্যার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সমাজের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে, সরকারের উচিত তা আমলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া। বাহিনীগুলোর ভাবমূর্তির স্বার্থেও এটা জরুরি।