সরকারের ভাবমূর্তি বনাম সিন্ডিকেট স্বার্থ

সরকার সম্প্রতি এক আদেশে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবিরকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বদলি করেছে। তিনি সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাছাই করা ১০ জন কর্মকর্তা দিলে তিনি তিন মাসের মধ্যে সরকারের দপ্তরগুলো থেকে দুর্নীতি নির্মূল করবেন। ফেসবুকে এ বিষয়ে আলোচনায় কেউ কেউ এটিকে তাঁর বদলির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি রেলের টিকিট কাটায় বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে গিয়ে সিন্ডিকেটের বিরাগভাজন হয়েছেন। এক এক করে বিষয় দুটি দেখা যাক।

মাহবুব কবিরের আবেগকে আমি সমর্থন করি। দুর্নীতি আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর পদ্ধতি সম্পর্কে আমার দ্বিমত আছে। প্রথমত, তিনি ১০ জন বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা নিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করবেন—এটা বাস্তবসম্মত নয়। কম দুর্নীতির জন্য প্রখ্যাত সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ একবার বলেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে যাঁরা সিঙ্গাপুর চালান, তাঁরা সবাই অনায়াসেই একটি মাঝারি আকারের বিমানের ধারণক্ষমতার মধ্যে আসন নিতে পারবেন। এ কথাটার মধ্যে মাহবুব কবিরের বক্তব্যের খানিকটা স্বীকৃতি আছে। তা হলো, ভালোভাবে দেশ চালাতে খুব বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না।

তবে অমিলটাই বেশি। যেমন বেসামরিক কর্মকর্তারাই শুধু সৎ হলে চলবে না; এ জন্য দায়িত্বে থাকা সীমিতসংখ্যক রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সামরিক, বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তা, বিচারক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক—তাঁদের একটি মোর্চা, তঁাদের সদিচ্ছা ও জনসমর্থন প্রয়োজন হবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ৫৭ লাখ জনসংখ্যার দেশ সিঙ্গাপুরে শ তিনেক ভালো মানুষের প্রয়োজন হলে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে অন্তত কয়েক হাজার ভালো মানুষের প্রয়োজন হবে। তা কেবল ১০ জন বেসামরিক কর্মকর্তা দিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তৃতীয় বিষয়টি হলো কেবল ভালো মানুষ দিয়ে দুর্নীতি তাড়ানো যাবে না; ভালো আইনকানুন, প্রতিষ্ঠান লাগবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সর্বব্যাপী দুর্নীতির বাংলাদেশে এত বড় কাজ তিন মাসে শুরু করা গেলেও শেষ করা সম্ভব নয়।

তাই বলে ভালো সরকারি কর্মকর্তারা কিছুই করতে পারবেন না এমনও নয়। এ জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো নামহীনতা (এনোনিমিটি)। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে ব্যক্তিগত প্রচার ও বাহবার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া এটা ভালো কাজ করার অন্তরায়। আমার ব্যক্তিগত জীবনে দেখা দুজন ভালো কাজ করা মানুষের কথা এখানে উল্লেখ করছি। একজন আমার গুরু খালিদ শামস, অন্যজন আমার বন্ধু আল্লাহ মালিক কাজেমী। তাঁরা দুজনেই ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালের মানুষ। কাজেমী মারা যাওয়ার পর তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের কাছ থেকে তাঁর ভালো কাজের বিষয়ে জানা যায়। আর বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত জেলা প্রশাসক খালিদ শামস সম্পর্কে বরিশালে গল্প শুনেছিলাম তাঁর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের অনেক পরে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা কীভাবে তাঁকে সমীহ করতেন।

সততা কোনো ব্যাধি নয় যে তা প্রচার করে বেড়াতে হবে। সততাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। আমরা বলে বেড়াই না যে আমি সুস্থ আছি; বরং কেবল অসুস্থ হলেই বলি, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত সততা ব্যাধিতে পরিণত হওয়ার গল্প শুনেছিলাম বনিয়াদি প্রশিক্ষণকালে শাহবাগের সরকারি কর্মচারী প্রশিক্ষণ একাডেমির প্রশিক্ষক আহবাব আহমদ সিএসপির কাছ থেকে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অত্যন্ত সৎ, এটা জেলার সবাই জানতেন। এ জন্য তাঁর খুব বড়াই ছিল। একদিন এজলাসে মামলা শুনে তিনি বাদীর পিতাকে খুনের বিষয়ে নিশ্চিত হন এবং পরের দিন বিবাদীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিবাদীপক্ষের উকিল শেষ চেষ্টা হিসেবে বাদীপক্ষের উকিলের নামে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় এক ঝাঁকা বড় মাছ, মাংস, হাঁস–মুরগি, কলা, পেঁপে, সবজি, দুধ ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেগে আগুন হয়ে যান। সবাই জানে, আমি একজন অত্যন্ত সৎ কর্মকর্তা। কত বড় সাহস বাদীপক্ষের উকিলের, আমাকে কিনা ঘুষ পাঠায়! পরদিন এজলাসে গিয়ে রেগেমেগে তিনি সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাদীপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য বিবাদীকে খালাস দিয়ে দেন।

তাই মাহবুব কবিরসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তা যাঁরাই ভালো কাজ করতে চান, তাঁদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে, নামহীন ও গর্বহীন হোন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিন। অন্তত দপ্তরের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু না বলাই ভালো। আমি মাহবুব কবিরের ফেসবুক প্রোফাইল দেখেছি। সেখানে বলা আছে, তিনি একজন ‘পাবলিক ফিগার’। একজন সরকারি কর্মকর্তা ‘পাবলিক সারভেন্ট’, কোনো অবস্থাতেই ‘পাবলিক ফিগার’ নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকুন দুর্নীতিপরায়ণ, অপদার্থ, চামচা, তেলমর্দনকারী ও আত্মজাহিরকারী কর্মকর্তারা। নিজেরা না পেটালে তাঁদের ঢোল পেটাবার কেউ নেই।

আমার মা বলতেন, আকাশে সূর্য উঠলে সবাই দেখবে। সূর্যকে জানান দিতে হয় না। সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের ভালো কাজের কথা অন্যদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে দিন। তবে এ জন্য সরকারি অর্থ ব্যয় করে কতিপয় ‘খ্যাতিমান’ আমলা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক গভর্নরের মতো লোক পুষবেন না।

মাহবুব কবিরকে ওএসডি করায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পোশ্য সমিতির এক নেতা। তাঁর বক্তব্য, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধের নামে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীদের বিমুখ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ট্রেনের টিকিট ১০০ শতাংশ অনলাইনে দেওয়া, টিকিট কাটতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হলে ট্রেন ভ্রমণে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন, রেলওয়ের শ্রমিক কর্মচারীরা অধিকারবঞ্চিত হবে। কী অকাট্য যুক্তি! অনুমান করি, এটাই মাহবুব কবিরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলের টিকিট কালোবাজারি সিন্ডিকেটের স্বার্থহানি করতে গিয়েই মাহবুব কবিরকে ওএসডি হতে হলো।

এর আগেও মাহবুব কবিরকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টকে নিরাপদ খাদ্য তৈরিতে উৎসাহিত করা, সে অনুযায়ী তাঁদেরকে রেটিং দেওয়া, খারাপগুলোকে শাস্তি দেওয়া—এসব কাজ তিনি সাহসের সঙ্গে করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা সন্দেহজনক কোটি কোটি টাকার খাদ্য বন্দরে আটকে দিয়েছেন। সেখানে তিনি টিকতে পারলেন না।

আমার এক ছাত্র লিখেছে, কিছুদিন রেলে ভ্রমণ করে তার মনে হচ্ছিল, সে উন্নত বিশ্বের কোনো বাহনে চলাফেরা করছে৷ অনলাইনে টিকিট বুকিং নিয়ে দুর্নীতি, ট্রেনের মধ্যে যাত্রী পরিবহনে অনিয়ম উল্লেখযোগ্য হ্রাস পেয়েছিল। এতে অনেকেরই পেটে লাথি পড়েছে। তাই মাহবুব কবিরকে সরানো হলো। আরেক বন্ধু লিখেছেন, সারা জীবন সৎ থেকে মানুষের পাশে থাকাটা কি অপরাধ? দুর্নীতিমুক্ত দেশের কথা বলা অপরাধ? দুর্নীতি আর ব্যর্থতার দায়ে যঁার বিচার হওয়ার কথা, তিনি হন সিনিয়র সচিব (আগের স্বাস্থ্যসচিব) আর যিনি সততার সঙ্গে লড়াই করেন, তিনি হন ওএসডি—এটা কেমন নিয়ম?

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মন্তব্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, মাহবুব কবির যেসব সরকারি দপ্তরে কাজ করেছিলেন, সেসব দপ্তর সম্পর্কে তিনি একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা একটা বড় অর্জন বলে আমি মনে করি। যেখানে যোগাযোগ, স্বাস্থ্য খাত, আইনশৃঙ্খলা, ব্যাংকসহ প্রায় সব সরকারি খাত; নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুদক সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে মাহবুব কবিরের মতো কয়েকজন আবেগপ্রবণ কর্মকর্তাকে জনস্বার্থে কাজ করতে দিলে ক্ষতি কী? এর ফলে অন্তত সরকারের তলানিতে থাকা ভাবমূর্তির খানিকটা হলেও চুনকাম হবে। এবং তা সরকারের জন্যই ভালো হবে।

সরকারকে নিজের ভাবমূর্তি বনাম সিন্ডিকেট স্বার্থের ভারসাম্য বিষয়ে ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সুমতি আশা করছি। মাহবুব কবিরকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে তাঁর পূর্বতন পদে ফিরিয়ে নেওয়া হবে—এটাই নাগরিক প্রত্যাশা।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ