জলমগ্ন নিঃস্ব হাতগুলো

ট্রলারের দিকে সাঁতরে ছুটে আসছে অনেক মানুষ, যাঁদের টোকেন ছিল না, যাঁরা ত্রাণ পাননি, সামনে পেতে দিয়েছেন জলমগ্ন নিঃস্ব হাত। ছবি: লেখক
ট্রলারের দিকে সাঁতরে ছুটে আসছে অনেক মানুষ, যাঁদের টোকেন ছিল না, যাঁরা ত্রাণ পাননি, সামনে পেতে দিয়েছেন জলমগ্ন নিঃস্ব হাত। ছবি: লেখক

জলমগ্ন নিঃস্ব হাতগুলো ভুলতে পারছি না কিছুতেই। যত সময় যাচ্ছে, ততই দৃশ্যটা যেন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা গিয়েছিলাম, ‘লেখক-শিল্পী সমাজ’–এর ব্যানারে গণচাঁদায় সংগ্রহ করা টাকা নিয়ে। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে অর্থ বিতরণই ছিল উদ্দেশ্য। অতীতে অনেকবার অপ্রস্তুত অবস্থায় সাহায্য দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার আগাম তালিকা করিয়ে রাখা হয়।

তালিকার বাইরে থাকা মানুষগুলোর প্রয়োজনও যে অনেক, সেটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমাদের ট্রলার (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) তীর থেকে দুধকুমার নদের দিকে চলছে, ট্রলারের দিকে সাঁতরে ছুটে আসছে অনেক মানুষ, যাঁদের টোকেন ছিল না, যাঁরা ত্রাণ পাননি, সামনে পেতে দিয়েছেন জলমগ্ন নিঃস্ব হাত। খামার রসুলপুর গ্রামে দেখা এই একটি দৃশ্য বন্যাকবলিত মানুষ যে কী অবর্ণনীয় কষ্টে আছে, সেটা দৃশ্যমান করল আমাদের সামনে। এবার কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্রতীরের পোড়ার চর, দুধকুমারতীরের খামার রসুলপুর, তিস্তার করাল গ্রাসের শিকার কালীর মেলা ও রামহরি গ্রামে না গেলে কিছুতেই অনুধাবন করতে পারতাম না বাস্তবতাটা।

‘কেমন আছেন চাচা?’ ত্রাণ নিতে আসা পোড়ার চরের ইনসান আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর বয়স আনুমানিক ৭০ বছর। কান্নায় ভাঙা ভাঙা গলায় যা বললেন তা এমন:

দারুণ কষ্ট। মেম্বার চেয়ারম্যান হঠাৎ একদিন ঘুরে যান। বলেন, ‘আমরা কী দিব, সরকার কিছু দেয় না’। দুই মাসের ভেতরে ১০ সের চাউল দিয়েছে। আমরা নদীভাঙা লোক, এখানে থাকতে পারি না, কোথায় যাই কী করি। এখানে ফের নদী ধরল আমাদের, অনেক কষ্ট হচ্ছে, আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, যদি সরকার একটু চিন্তাভাবনা করেন, আমাদের একটু উপকার হয়।

এমনই ছিল তাঁর কথাগুলো।

‘আরকি’ বলাটা ইনসান আলীর মুদ্রাদোষ। কিন্তু আমার কানে তাঁর মুদ্রাদোষটাই গভীর হতাশা হয়ে ধ্বনিত হচ্ছিল। বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের কালীর মেলা গ্রামের সেই মানুষটির কথাও হয়তো কোনো দিন ভুলতে পারব না, যাঁর নামটি পর্যন্ত জানা হয়নি আমাদের। ফেরার পথে ভদ্রলোকের ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে চা পান করতে এটা-ওটা জানতে চাইছিলাম। তিনি আমাদের দেখালেন, তিস্তার ভাঙনে কত দূর পর্যন্ত সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তিনি বললেন, ‘কী আর করা, এর মধ্যেই জীবন।’

‘আরকি’ এবং ‘কী আর করা’ যেন একাকার হয়ে গেল। বন্যা এবার স্মরণকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে চলেছে। ‘এবার বন্যায় ৭৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে’—জুলাই মাসে খবরের কাগজে পড়া একটা প্রতিবেদনের কথা মনে এল। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা তিন দফা বন্যায় দেশের প্রায় ৩১ শতাংশের বেশি নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এই সব হিসাব-নিকাশ অনেক নদ-নদীর জেলা কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষ জানেন না। কিন্তু তাঁরা প্রত্যক্ষ করছেন জলে ভাসছে মানুষ, গবাদিপশু, ডুবন্ত খেতের ধান, ভেসে গেছে মাছ। দেখে দেখে বিবর্ণ হয়ে গেছে মানুষের জীবন। অনাহারে–অর্ধাহারে অসহায় অগণন মানুষ। তাঁরা জানেন, বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্গত অঞ্চলের মানুষ আক্রান্ত হবেন পানিবাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণুতে, অসুস্থ হয়ে পড়বে কৃষকের গবাদিপশু। একদিকে করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতি, অন্যদিকে এবারের দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় দেশের অর্ধকোটির ওপর মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে।

খবরের কাগজেই দেখলাম, জাতিসংঘের নেতৃত্বে উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি যৌথ জরিপ করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে মৌসুমি বন্যার প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ২১ জেলার ৭৫ লাখ ৩০ হাজার মানুষ চলতি বন্যার কবলে পড়তে পারে। তাদের মধ্যে ৩৮ লাখই নারী। পুরোপুরি বাস্তুচ্যুত হতে পারে ২ হাজার ৮৩৩ জন। এটি একটি ভয়াবহ চিত্র দেশের জন্য।

কুড়িগ্রামে প্রতিবছরই বন্যা হয়, এই জেলায় বন্যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের অংশবিশেষ। এ বছর বন্যায় কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী ছিল। বন্যার কারণে বিভিন্ন ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষকেরা। প্রতিবছরের মতো এবারের বন্যায় কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের ফসলি আবাদ পানিতে তলিয়ে প্রায় ১৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। লক্ষাধিক কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা গেছে, দুই দফা বন্যায় কুড়িগ্রামে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টর জমির পাট, বীজতলা ও বিভিন্ন ধরনের সবজিসহ আনুমানিক ১৪০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

দেশের কৃষিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয়, সে বছর রবি মৌসুমের (শীতকালীন) ফসলের ফলন ভালো হয়। এর কারণ হলো, বন্যার মাত্রা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব পলিতে গাছের বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে। তা ছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয়, সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য—গম, ডাল ও তেলজাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারেন।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বন্যায় যেহেতু কৃষকের বীজধান ও শস্যবীজ নষ্ট হয়ে গেছে, সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষক সংগঠন করে বীজ রক্ষণাগার তৈরি করতে হবে এবং কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া সরকারের পাশাপাশি দেশের সব মানুষকে সামর্থ্য অনুসারে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ সময় সবাই সহযোগিতার হাত না বাড়ালে শিগগিরই দেশে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। তাই জরুরিভাবে দরকার বন্যার্তদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তাহলেই এই দুঃসময় অতিক্রম করা সম্ভব হবে।

শাহেদ কায়েস: কবি, পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী