আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস: করোনাকালে জাতীয় উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি

প্রথম আলো ও এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারীরা
প্রথম আলো ও এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারীরা

প্রথম আলো ও এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) আয়োজনে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস: করোনাকালে জাতীয় উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় ৮ আগস্ট ২০২০ সেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া আলোচকদের বক্তব্যের সারমর্ম এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

ফজলে হোসেন বাদশা এমপি
আহ্বায়ক, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস

সৈয়দ আবুল মকসুদ
বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক

রানী য়েন য়েন
মানবাধিকার কর্মী, রাঙামাটি

সাদেকা হালিম
অধ্যাপক;ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্জীব দ্রং
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

খুশী কবির
সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
চেয়ারপারসন, এএলআরডি

গৌতম দেওয়ান
সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি

শামসুল হুদা
নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি

রবীন্দ্রনাথ সরেন
সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদ

রওশন জাহান মনি
উপ-নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি

সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম
জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে এই গোলটেবিল আলোচনা। পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সমতলের গারো, হাজং, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার জীবনমান উন্নয়নে অনেক সমস্যা রয়েছে, করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। এ সমস্যাগুলোকে কীভাবে আমরা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, যেটাকে আমরা বলছি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন—এসব বিষয় নিয়েই বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করবেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মূল কথাই হচ্ছে, কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পার্বত্য অঞ্চল ও সমতলের সব জাতিসত্তার প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।

রওশন জাহান মনি
রওশন জাহান মনি

রওশন জাহান মনি
৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’। প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও আমরা দিবসটি পালন করছি। এমনিতেই তারা সারা বছর নানা সমস্যায় থাকে। কোভিড-১৯-এ নতুন চ্যালেঞ্জ যু্ক্ত হয়েছে। করোনা তাদের জীবনে আরও মারাত্মক সংকট নিয়ে এসেছে। এই বিশ্বায়নের যুগেও তারা ভয়াবহ প্রান্তিকতার মধ্যে আছে।

এএলআরডি প্রান্তিক জনমানুষের ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করে। আমরা মনে করি, ভূমি অধিকারের দিক থেকে যারা পিছিয়ে রয়েছে, তাদের জন্য কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সারা বছর ধরে কাজ করি। বিশেষ দিনগুলোতে আমরা সেটি কিছুটা বিশেষভাবে করার চেষ্টা করি। এর মাধ্যমে সার্বিক অবস্থাটা আরেকবার ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। পাওয়া না–পাওয়া এবং যে অপূর্ণতাগুলো রয়েছে, তা আবার সামনে উঠে আসে। আশা করছি, আজকের এ ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে আসবে। একই সঙ্গে কিছু দিকনির্দেশনা ও সুপারিশ আসবে। এএলআরডি এসব সুপারিশ যথাযথ জায়গায় তুলে ধরার চেষ্টা করবে। শুধু এক দিনের আদিবাসী দিবস নয়, বঞ্চনা দূর করতে ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সারা বছরব্যাপী এএলআরডি কাজ করে যাবে।

সঞ্জীব দ্রং
সঞ্জীব দ্রং

সঞ্জীব দ্রং
প্রতিবছর অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে আমরা ৯ আগস্ট জাতীয়ভাবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উদ্‌যাপন করি। মনে বড় আশা জাগে, প্রিয় জন্মভূমি একদিন পাহাড়-সমতলের প্রান্তিক জাতিসত্তার সব নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানবিক ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। রাষ্ট্র হবে ইনক্লুসিভ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, কেউ অধিকার ও উন্নয়ন ধারা থেকে বাদ পড়বে না।

এবারের দিবসটি জাতিসংঘ ঘোষিত ২৬তম আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজুলেশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং দিবসটি পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়। ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়’ স্লোগান নিয়ে জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-২০৩০ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।

বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিয়ে এসডিজির কথা বলছে। পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জাতিসত্তার নাগরিকদের পেছনে ফেলে রেখে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দেশে এ বিষয়ে একটি নীতি বা পলিসি থাকা দরকার। সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ জরুরি।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গেজেটে (মার্চ ২০১৯) পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা, ময়মনসিংহের গারো-হাজং, উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল-উরাও, সিলেটের খাসিয়া-মনিপুরী, উপকূলীয় অঞ্চলের রাখাইন সহ ৫০টি জাতিসত্তার উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও তাদের কথা বলা হয়েছে।

সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এথনিক মাইনোরিটি ইস্যু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি সেখানেও এটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এই করোনা দুর্যোগের সময় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি তুলে ধরছি:

১. পাহাড় ও সমতল—দুই ক্ষেত্রের সব জাতিসত্তার মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেহেতু তারা অতি প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অবস্থা নাজুক, তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসব অঞ্চলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে;

২. করোনা মহামারির কারণে যেসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনিশ্চিত জীবনের সম্মুখীন, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় এককালীন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করতে হবে;

৩. পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জাতিসত্তার কমপক্ষে ২৫ হাজার তরুণকে করোনাকালে খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাঁরা পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে পারেন;

৪. দরিদ্র ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে না পড়ে, তার জন্য আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;

৫. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নে পাহাড় ও সমতলের জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে;

৬. আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস কর্তৃক প্রণীত খসড়া ‘আদিবাসী অধিকার আইন’টি পাশ করতে হবে।

সাদেকা হালিম
সাদেকা হালিম

সাদেকা হালিম
বাংলাদেশ একটি বহুমাত্রিক ও বহু সম্প্রদায়ের দেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সমতল বা অন্যান্য এলাকায় যারা বাস করে, তারা সনাতনী ভূমিব্যবস্থায় বিশ্বাস করে, সেটাই তারা চর্চা করে এসেছে। তাদের এই অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। রিজার্ভ ফরেস্ট, উন্নয়ন প্রকল্পের স্থাপনা, ট্যুরিজম—বিভিন্নভাবে তাদের ভূমি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চল ও সমতল দুই জায়গাতে তাদের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, তা একসঙ্গে বলা প্রয়োজন, আবার আলাদা করেও বলা প্রয়োজন।

১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছে। হয়তো সেটি চর্চার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে অবশ্যই আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। আমরা জানি, আঞ্চলিক পরিষদে যে পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন থাকার কথা ছিল, সেটা নেই। যে জমি তারা হারিয়ে ফেলছে, সেটা ফিরে পাওয়ার কোনো বিধিবিধান নেই। চুক্তির ফলে তারা একটা মন্ত্রণালয় পেয়েছে। কিন্তু সমতলের জাতিগোষ্ঠীর দাবি হলো, তারাও একটা পৃথক মন্ত্রণালয় চায়।

প্রথমআলোর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড আক্রান্তের হার কম। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তাদের জীবনযাত্রা ও কঠোর পরিশ্রম। কিন্তু যেভাবে তারা পরিশ্রম করে, সেভাবে খাবার গ্রহণ করতে পারে না।

একটা অভিজ্ঞতা বলি: সম্প্রতি জীবিকা নিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রামের তিনটি জেলা এবং সমতলের রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় একটি গবেষণা করেছি। তাঁরা বলছেন, ‘কৃষিকাজ করি।’ কিন্তু অধিকাংশই কাজ করছেন দিনমজুর হিসেবে। বিভিন্ন ধরনের কাজ করে তাঁরা দিনাতিপাত করছেন। তাঁরা বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকায়ন চান। ৭৬ শতাংশ প্রযুক্তির আধুনিকায়ন চাইছেন। তাঁরা তাঁদের কম মজুরির কথা বলেছেন। নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা বলেছেন।

সমতলের জাতিসত্তার অনেক নারী পারলার, কারখানায় ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। অনেকে বিভিন্ন চাকরিতে ছিলেন। কোভিডের ফলে তাঁদের অধিকাংশ কাজ হারিয়েছেন। এ বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তা না হলে তাঁরা প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়ে পড়বেন।

আমরা এখনো মূলধারার উন্নয়ন ডিসকোর্স পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নের জন্যও ব্যবহার করে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলব, বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্য একটি দেশকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। আমরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার যত বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতা নিয়ে আসতে পারব, ততই আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হবে।

করোনা কতটা দীর্ঘায়িত হবে, আমরা জানি না। পাহাড় ও সমতলে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আছে, তাদের যদি এখনো প্রণোদনার আওতায় না আনা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে। তাদের স্বাস্থ্য-সুবিধা নেই বললেই চলে। কিন্তু তাদের তো স্বাস্থ্যসেবা দরকার। জরুরি ভিত্তিতে তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ
সৈয়দ আবুল মকসুদ

সৈয়দ আবুল মকসুদ
করোনাকালে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ পালনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ পাহাড়ে আছে, সমতলেও আছে। তারা এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত, এর মধ্যে করোনার কারণে নতুন সমস্যা তাদের জীবনে দেখা দিয়েছে। তাদের অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তের হার কম, কিন্তু এখন তাঁরা বেকারত্বের সমস্যায় আক্রান্ত।

সংবিধানে যেমনটি বলা আছে, রাষ্ট্রের প্রধান মৌলিক দায়িত্ব হলো অনগ্রসর জনগণকে তাদের শোষণ থেকে মুক্ত করা। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তারা রাষ্ট্রের আনুকূল্য ছাড়া নিজেরাই কর্মের সংস্থান করে নিচ্ছেন। গাড়িচালক, পারলার, পোশাকশিল্পসহ অনেক ধরনের কাজ তাঁরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। করোনার এই সময়ে তাঁরা কাজ হারাচ্ছেন। তাঁদের অনেকের অভুক্ত থাকার অবস্থা হয়েছে। সরকার বিভিন্ন জায়গায় প্রণোদনা দিচ্ছে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিশেষ প্রণোদনার প্রয়োজন রয়েছে।

পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও আপ্রাণ চেষ্টায়। যখন কোনো চুক্তি হয়, তখন ধরেই নেওয়া হয় যে এই চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু চুক্তিটি গত দুই যুগেও এর অনেকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। নাগরিক সমাজ, এএলআরডি ও অন্যান্য সংস্থা থেকে অনেক দিন ধরে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রের দিক থেকে এটা পরিষ্কার করা উচিত, কী কী কারণে এই চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। পার্বত্য চুক্তির যে ধারাগুলো এখনো বাস্তাবয়িত হয়নি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। আজকের ‘আদিবাসী দিবস’-এর এই দিনে আমাদের কর্তব্য হবে, তাদের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া। তাদের পক্ষ হয়ে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরা।

রানী য়েন য়েন
রানী য়েন য়েন

রানী য়েন য়েন
সবাইকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে’র শুভেচ্ছা। দেশে একটা আর্থসামাজিক বিভাজন আছে। কিন্তু সেটা কতটা প্রকট, কতটা বিস্তৃত, এই করোনাকালে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। এই বৈষম্য, বিভাজন কাঠামোগত। এই ধারা কিন্তু চলতেই থাকবে, যদি না পরিবর্তন আনা হয়। ভিন্ন জাতিসত্তা, ভিন্ন আইডেনটিটি বৈষম্যের মূল কারণ। ভিন্ন জাতিসত্তা আর্থসামাজিক নিদারুণ অবস্থার জন্য দায়ী।

উন্নয়নের প্রশ্নে অধিকার জড়িত। অধিকারের প্রশ্নটি উপেক্ষা করে বা অধিকার লঙ্ঘন করে যে অগ্রগতি, তা কোনাভাবেই উন্নয়ন হতে পারে না। আমাদের দেশে সেই আশি-নব্বইয়ের দশকের নিউ লিবারেল উন্নয়ন ধারণা চলছে, যেখানে অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয় না। এই বাস্তবতা বুঝতে পেরে বিশ্বনেতারা সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) থেকে সরে এসে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।

বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে। এসডিজির মূলকথা হলো: কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। যারা পিছিয়ে আছে, তাদের গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। তা কিন্তু করা হচ্ছে না। পিছিয়ে থাকার কারণ কী, সেটি নির্ধারণ করতে হবে। সে জন্য দরকার বিভাজিত তথ্য, বিশেষ করে এথনিসিটি ও লিঙ্গভিত্তিক তথ্য। এসডিজি বাস্তবায়নে সবার আগে এটি করা প্রয়োজন। কিন্তু এখনো সেটা করা হয়ে ওঠেনি। গড়পড়তা হিসাব দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন মাপলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে ঠিকই পরিণত হতে পারব, কিন্তু ‘কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না’—এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন অসম্ভব।

আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক এলাকা আছে, যেখানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নাই। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও স্বাস্থ্যকর্মী নাই। স্বাস্থ্যকর্মী থাকলেও ওষুধ ও যন্ত্রপাতি নাই। প্রত্যন্ত এলাকা বিবেচনায় বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার, সেটাও নাই।

সমতল ও পাহাড়ি এলাকার ভৌগোলিক বাস্তবতায় উন্নয়ন কার্যক্রম এক হবে না। যাদের ভূমি আছে, আর যারা ভূমিহীন, তাদের জন্য আলাদা আলাদা উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের ভূমি দখল হয়ে গেছে, যারা অতিদরিদ্র, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।

আমরা অন্তর্ভুক্তির কথা বলছি। কারণ, তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে তারাই সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। শুধু উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়, এর সঠিক বাস্তবায়নে তাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে পারলেই যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব। আমি অংশগ্রহণ নয়, অংশীদারত্ব শব্দটি ব্যবহার করেছি। এই দুটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। জাতীয় উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজেটে আমাদের অংশীদারত্ব নেই। এমনকি অংশগ্রহণও নেই। পার্বত্য অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ আছে ঠিকই, কিন্তু এর কত অংশ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়, আর কত অংশ পার্বত্য এলাকার মানুষ পায়, সাধারণ জনগণের জানা নেই। সেখানে যদি আমাদের অংশীদারত্ব থাকত, বাজেটের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা সহজ হতো।

কোভিড একটি জাতীয় ও বৈশ্বিক সংকট। তবে কোভিড-১৯ একটি পরিস্থিতি মাত্র, তার আগে থেকেই তো আমাদের জনগণ কাঠামোগতভাবে বৈষম্যের শিকার। যেকোনো সংকটে যেন আমরা প্রস্তুত থাকতে পারি, সে জন্য যে বৈষম্যগুলো বিদ্যমান রয়েছে, সেটা নিরসন করা প্রয়োজন। আমরা যে কথাগুলো বলে আসছি, সেটা করোনা সংকটের সময়ও বলতে হবে, স্বাভাবিক সময়েও বলতে হবে। আদিবাসী দিবসে সেই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।

রবীন্দ্রনাথ সরেন
রবীন্দ্রনাথ সরেন

রবীন্দ্রনাথ সরেন
২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করব। এই ৫০ বছরে হিসাব করলে দেখা যাবে, আমাদের জনগণের বেশির ভাগ জমি দখল হয়ে গেছে। তাদের হাতে আর তেমন জমি নেই। সমতলের জাতিসত্তার কথা যদি বলি, এখানে ৮ শতাংশ মানুষের হাতে কিছু জমি আছে। বাকিরা ভূমিহীন।

আমরা তো শহরমুখী ছিলাম না, ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে অনেকে শহরে কাজ করছেন। করোনার সময়ে শহরে কাজ করেন, এমন ১৫ থেকে ২০ হাজার ছেলেমেয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। তাঁরা এখন বেকার। তাঁরা কৃষিকাজ করতে পারেন। কিন্তু এখন তো তাঁদের কাজ নেই। সরকারের ত্রাণ তো আমরা কেউ পাচ্ছি না। আমি তো গ্রামে থাকি। যাঁরা নেতা, তাঁরা নিজেদের চেনা-পরিচিত লোকদের ত্রাণ দেন। আমাদের সাঁওতাল, উরাওদের কতজন ত্রাণসহায়তা পেয়েছেন? কজন নারী বিধবা ভাতা পেয়েছেন। কিছুই তো পাননি। তাঁদের জন্য যদি পুনর্বাসনে আলাদা কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের জনগোষ্ঠীর মানুষেরা টিকে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকতে পারবে না। জীবন দুর্বিসহ হয়ে যাবে। জমি যদি না থাকে, তাহলে তো আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না। কোথায় থাকবে? কীভাবে থাকবে? আমরা সরকারকে কর দিচ্ছি। কিন্তু সেই তুলনায় কী সহায়তা পাচ্ছি? আমাদের জন্য কী কী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সে আলোচনা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাই আদিবাসী দিবসে আবারও বলছি, আমাদের অধিকারের কথা বলে যেতেই হবে।

শামসুল হুদা
শামসুল হুদা

শামসুল হুদা
‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে আমাদের আলোচনা, সেখানে মূল ফোকাস করোনা সংকট। আজ পৃথিবীজুড়ে করোনা এক মহাসংকট। আমাদের দেশও এ সংকটের মধ্যে রয়েছে। করোনা মহামারি দেশের ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চল ও সমতলের জাতিসত্তার প্রতি বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন বরাবরই ছিল। ২০০৮ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ অনেক বছর এ ইশতেহার অনুসরণ করেছে। বর্তমান সরকারপ্রধান কয়েকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর সরকার পার্বত্য চুক্তি করেছে। সব বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি সাহসের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। পৃথিবীজুড়ে এটি প্রশংসিত হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এই আইনও দীর্ঘদিন বাস্তবায়িত হয়নি। অর্পিত সম্পত্তি আইন যে কারণে বাস্তবায়িত হয়নি, সে কারণগুলো দূর করে আইনটি সংশোধন করার যে সিদ্ধান্ত, সেটিও অত্যন্ত বলিষ্ঠ। এ ক্ষেত্রেও তিনি দূরদর্শী ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি।

সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেই জনগণের অংশ কি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নন? অবশ্যই তারা অংশ। এই সরকারই তাদের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সরকারই সেটি বাস্তবায়ন করতে পারে। আদিবাসী দিবসে আশা করি তারা বিষয়টি মূল্যায়ন করবে।

করোনার ব্যাপারে বলতে হয়, করোনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা, আমাদের জন্য বিশেষ সমস্যা। করোনা সংকট হয়তো আমাদের দীর্ঘদিন মোকাবিলা করতে হবে। বিআইডিএস ও বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় এসেছে, প্রায় দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবে। পাহাড়, সমতল ও দুর্গম অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জন্য এই সংকট আরও চরম। তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে, প্রণোদনা দিতে হবে। প্রণোদনা কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, এটা তাদের অধিকার।

এ বছর জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ চলছে। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর। কিন্তু আমরা কী অর্জন নিয়ে যাচ্ছি, সেটা ভেবে দেখতে হবে। যেখানে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার, সেখানে আলো ফেলতে হবে। সবচেয়ে যারা পিছিয়ে আছে, তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এগিয়ে আনতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছরে পাহাড়ি ও সমতলের সব প্রান্তিক মানুষের যেন ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, সে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। সবাইকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।

গৌতম দেওয়ান
গৌতম দেওয়ান

গৌতম দেওয়ান
কোভিড-১৯ সারা বিশ্বের সমস্যা। কিন্তু আমরা যারা সমতল বা পার্বত্য অঞ্চলে আছি, এ সমস্যার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আমরা। কারণ, আমাদের জনগণ প্রান্তিকের চেয়েও প্রান্তিক। রবীন্দ্র সরেন সমতলের কথা বলেছেন। আমি পার্বত্য অঞ্চলের কথা বলতে চাই। সরকারের করোনা সহায়তার বিষয়ে একটি জরিপ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা বোধ হয় পার্বত্য অঞ্চলের বাস্তব অবস্থা এখনো বোঝাতে পারিনি।

আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা অনেক দুর্গম। দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে হবে না। হয়তো পরিবারপ্রতি ১৫ কেজি চাল দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ মেটাতে তালিকা থেকে অনেকের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে, না হলে কম চাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা জেনেছি, রাঙামাটি জেলার পাঁচটি গ্রামে জনপ্রতি মাত্র দুই কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এই দুই কেজি চাল সংগ্রহ করতে অনেক দূর থেকে অনেককে আসতে হয়েছে।

আমাদের রাঙামাটি ও বান্দরবন অঞ্চল প্রায় সম্পূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। সমতল ভূমি নেই বললেই চলে। জুমচাষনির্ভর জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে। বর্ষাকালে তাদের ঘরে কোনো খাবার থাকে না। তাদের ঘরে ধান আসতে আরও দুই মাস লাগবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা। ফলে আমাদের জন্য এটা একটা বিরাট দুর্যোগ। আমাদের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক, এখানে চাকরির কোনো সুযোগ নেই। তাই অনেকেই এখান থেকে ইপিজেডে কাজ করতে যায়। আমাদের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ হাজার যুবক কাজে যেতে পারছেন না। একটা বিরাটসংখ্যক যুবশ্রেণি বেকার হয়ে বসে আছে।

পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছর হতে চলল। কিন্তু এখনো এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না। ২০০১ সালে ভূমি কমিশন গঠিত হয়। সেই কমিশনে ত্রুটি ছিল। আমাদের দাবির ফলে ২০১৬ সালে এটি সংশোধন করা হয়। ২০২০ সালের অর্ধেক চলে গেল। কিন্তু এখনো এর বিধিমালা হয়নি। তাই ভূমি কমিশন কোনো কাজ করতে পারছে না।

কোভিড হয়তো আরও দীর্ঘায়িত হবে। আমরা আশাবাদী, সরকার নিশ্চয় আমাদের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমাদের দাবি থাকবে, সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে আমাদের জনগোষ্ঠীকে যেন সম্পৃক্ত করা হয়, পাহাড়ি মানুষের অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত হয়। তবেই তা সঠিকভাবে কাজে লাগবে।

ফজলে হোসেন বাদশা
ফজলে হোসেন বাদশা

ফজলে হোসেন বাদশা
কোভিড-১৯–এর সময়ে পাহাড় ও সমতলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংকট কী পরিমাণ বেড়েছে, অনেকেই সেটা বলেছেন। ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে প্রথমেই একটা দাবি উপস্থাপন করতে চাই: বাংলাদেশে বসবাসরত সব জাতিসত্তার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আগস্ট মাস। এ মাসে বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির জনক জীবন দিয়েছিলেন। সপরিবার নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই আমাদের সংবিধান। তিনি এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, বৈষম্য ও শোষণ থেকে এই দেশকে বের করে নিয়ে আসা হবে। এই সমাজটা হবে সমতাভিত্তিক সমাজ। আমাদের সেই সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।

অনেকেই পার্বত্য চুক্তির কথা বলেছেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তি কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, আজ এই প্রশ্ন কেন আসবে? কেন শতভাগ বাস্তবায়িত হবে না? পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থাকার জন্য বাজেটে পাহাড়ি জনগণের জন্য একটা বরাদ্দ থাকে। সমতলের জাতিগোষ্ঠীর জন্য এক টাকাও বরাদ্দ থাকে না। সমতলের জাতিসত্তার জন্য একটা আলাদা মন্ত্রণালয় দরকার। তা না হলে তারা নিঃশেষ হয়ে যাবে। পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি কমিশনকে সক্রিয় করতে হবে। আর সমতলে ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

গত পার্লামেন্টে ‘আদিবাসী অধিকার আইন’ বিষয়ে একটা বিল উপস্থাপন করেছি। সেটা আলোর মুখ দেখেনি। এবার আবার এটি উপস্থাপন করব।

মাতৃভাষায় শিক্ষা খুবই জরুরি। অনেক চেষ্টা করে আমরা এটা এনেছিলাম। প্রাক্‌–প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১০ বছরেও এটা বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড় ও সমতল- সব জাতিসত্তার শিশুদের শিক্ষার জন্য পৃথক একটা ইনস্টিটিউট করা দরকার। সেখান থেকে সাঁওতাল, মুন্ডা, গারো, চাকমা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষার বইপুস্তক প্রকাশিত হবে। এটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। এই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শুধু বইপুস্তক রচনা করবে, তা নয়, ছোট ছোট ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখবে।

সরকার কোভিড পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা ফি নির্ধারণ করছে। এই ফি ও যাতায়াত খরচসহ কোভিড পরীক্ষা করতে হলে একজনের কমপক্ষে ৫০০ টাকা খরচ হবে। একজন প্রান্তিক মানুষের পক্ষে এটি বহন করা সম্ভব নয়। প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা একেবারে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সরকার এটা দেখবে বলে আশা করি।

যেকোনো সংকটে দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বড় ধরনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কিন্ত আমাদের এখানে, ‍সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সিংহ ভাগ ব্যয় হয় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন ও কল্যাণ তহবিলে, এখানে অতিদরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ খুবই সীমিত। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে অনেক সমস্যা আছে, সেটা ভালোভাবে পর্যালোচনা করা দরকার।

খুশী কবির
খুশী কবির

খুশী কবির
‘আদিবাসী দিবসে’র আজকের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন, করোনা পরিস্থিতি ও তাঁদের অন্তর্ভুক্তিকরণ। কোভিড কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়,এটা সারা বিশ্বের সংকট। কোভিড-১৯-এ বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অবস্থা কী, জাতিসংঘ এটা নিয়ে ভাবছে। কীভাবে এটা তারা মোকাবিলা করবে, কীভাবে এর সঙ্গে চলবে, এসবই জাতিসংঘের ভাবনা।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চার মূলনীতিকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর থেকে আমাদের আদর্শ হত্যা করার প্রক্রিয়া, ইতিহাস বিকৃতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনকালে অবশ্যই চার মূলনীতির কাছে ফিরে যেতে হবে। এটা করতে হলে পাহাড় ও সমতলের সব অনগ্রসর প্রান্তিক জাতিসত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারা নির্ধারণ করবে উন্নয়ন ধারা? অন্তর্ভুক্ত কীভাবে হবে, এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যদি মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে, তাহলে দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন—কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হবে না। তাদের জমি প্রায় চলে গেছে। এখন তারা দিনমজুর। কৃষিতেও এখন তাদের তেমন কাজ নেই। অনেকের অবস্থা এমন যে আগে যেখানে তিন বেলা ভাত খেতেন এখন সেখানে দুই বেলা খান। তাদের এখন যেকোনো কাজ করে জীবন বাঁচতে হচ্ছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা যদি সবার অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে করোনা সংকটও আমরা মোকাবিলা করতে পারব। ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে বলতে চাই, এই করোনাকালে আরও বেশি করে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করে আমরা যদি তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখি, তাহলে সমতল ও পাহাড়ের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব। তাহলে কেবল করোনা নয়, সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত আজকের এই ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশ নেওয়ার জন্য সম্মানিত অতিথিদের প্রথমআলোর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।