সাংসদদের জন্য থোক বরাদ্দ না থোক দুর্নীতি?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, সাংসদদের অনুকূলে দেওয়া থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে কোনো নজরদারি ও জবাবদিহি না থাকায় অবারিত দুর্নীতি হচ্ছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি সংসদীয় আসনের থোক বরাদ্দের প্রকল্প পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ গবেষণা করেছে টিআইবি। তাদের পর্যবেক্ষণ হলো সাংসদেরা প্রকল্পের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় যেমন স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি জনগণের টাকায় নেওয়া এসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে দলীয় নেতা–কর্মীদের পকেটে। কাকে কাজ দেওয়া হবে, সেটাও ঠিক করেন সাংসদ। 

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের জন্য ৩০০ সাংসদই থোক বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। কিন্তু সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদেরা এ সুযোগ পান না। যুক্তি দেখানো হয়, তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নেই। কেবল সমাজে নয়, সংসদেও নারীর প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, সাংসদদের থোক বরাদ্দ চালু হয় বিএনপি সরকারের আমলে। বিএনপি সরকারের অনেক ভালো কাজ বর্তমান সরকার বাতিল করেছে, কিন্তু এই মন্দ দৃষ্টান্তটি রেখে দিয়েছে এবং টাকার অঙ্ক ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যেক সাংসদের অনুকূলে দুই কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল। পরে তা পাঁচ কোটিতে উন্নীত করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ বা আইআরআইডিপি। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়ন নয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্নীতি। 

বলা হয়েছে, গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ, গ্রোথ সেন্টার, হাটবাজার উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা, কৃষি-অকৃষি পণ্যের বিপণন সুবিধা বৃদ্ধি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত করা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। কেবল গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরেও অনুরূপ প্রকল্প আছে। এ বিষয়ে ঢাকার একজন সাংসদের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বলেন, প্রকল্পের নাম দেওয়া ছাড়া তঁাদের কোনো ভূমিকা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিটি করপোরেশন।

বর্তমানে ৩০০ আসনে প্রত্যেক সাংসদের বিপরীতে ২০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে অভিযোগ এসেছে, সরকার তাদের বরাদ্দ কমিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উন্নয়নকাজ করে থাকে। তদুপরি সাংসদদের নামে মোটা অঙ্কের থোক বরাদ্দ। টিআইবির গবেষণায় থোক বরাদ্দের বিভিন্ন প্রকল্পের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। এসব প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগ, নির্মাণকাজে মালামাল সরবরাহ ও অর্থছাড়—কোনো পর্যায়ে জবাবদিহি নেই। বরাদ্দের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে ১৪টি ধাপে কমিশন দিতে হয়। অনেক সময় দলীয় লোকদের কিছু পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে অর্থ খরচ হয় ঠিকই, কিন্তু জনগণের কোনো উপকার হয় না। 

টিআইবি সরাসরি থোক বরাদ্দ বাতিল করার পরামর্শ দেয়নি; আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে বলেছে। তবে এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সাংসদের কাজ হলো উন্নয়নকাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা তদারক করা। আমি মনে করি, আদর্শ অবস্থান হলো সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সাংসদের দূরে থাকা। 

স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার বা শাসনকাঠামো জোরদার করার চেষ্টা করেনি। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করারও চিন্তা নেই। বরং বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকারকাঠামোকে পঙ্গু করার জন্য ওপর থেকে সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। জিয়াউর রহমানের আমলে ‘জেলা মন্ত্রী’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল স্থানীয় শাসনের ওপর খবরদারি করতে। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবীরের বেঞ্চ ‘জেলা মন্ত্রী’ পদ বাতিল করে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, তাতেও বলা হয়েছিল, স্থানীয় সরকারের উন্নয়নকাজে সাংসদদের অংশগ্রহণ সংবিধানবিরোধী। 

গতকাল এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাংসদদের জন্য থোক বরাদ্দ দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। সংবিধানে আছে, সাংসদেরা আইন প্রণয়ন করবেন এবং তাঁর এলাকার উন্নয়নকাজ তদারক করবেন। তদারক করা মানে সেই কাজগুলো ঠিকমতো হয়েছে কি না, তা তদারক করা, জবাবদিহি আদায় করা। যিনি জবাবদিহি আদায় করবেন, তিনি নিজেই যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, তাহলে জবাবদিহি কী করে হবে? দ্বিতীয়ত, উন্নয়নকাজ হলো একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। কার্যাদেশ দেওয়া থেকে বিল পরিশোধ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে কাজের জবাবদিহি থাকতে হবে। এসব কাজ করার জন্য সাংসদদের তো কোনো অফিস বা লোকবল নেই। ফলে তাঁরা দলীয় লোকদের ওপরই নির্ভর করেন। স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও ‘এমপি সাহেবের’ প্রকল্প বলে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। ফলে উন্নয়নকাজের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, অর্থের অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা যখন দেখেন সাংসদের প্রকল্প নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে, তখন অন্যান্য প্রকল্পেও কোনো জবাবদিহি থাকে না। 

বিএনপি আমলের থোক বরাদ্দের পরিণামের কথা উল্লেখ করে অপর একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ভোলার সাবেক সাংসদ হাফিজ ইব্রাহিম থোক বরাদ্দ দিয়ে দেড় শ থেকে দুই শ ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করেছিলেন, যার বেশির ভাগই কাজে লাগেনি। রাস্তা ছাড়াই এসব ব্রিজ–কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছিল। বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই বলে সেই সময়ের সাংসদের ‘কীর্তি’ আমরা জানতে পারছি। আওয়ামী লীগ আমলের সাংসদদের কীর্তি জানতে সরকার পরিবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কি না, কে জানে। 

টিআইবির প্রতিবেদন সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাংসদদের থোক বরাদ্দ সম্পূর্ণ সংবিধানবিরোধী। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তারপরও সরকার অগ্রাহ্য করে সাংসদদের থোক বরাদ্দ দিয়ে চলেছে। স্থানীয় শাসনকাঠামোকে পঙ্গু করাই এর উদ্দেশ্য। 

তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে কঠিন কথাটি বলেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁর মতে, ‘থোক বরাদ্দের এই টাকা পুরোপুরিই ওয়েস্টেজ হয়। কারণ, এমপি সাহেবেরা যখন বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রস্তাব দেন, এলজিইডির (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) প্রকৌশলীরা তখন কাজ করেন না। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকৌশলীরা অনেক অজুহাত দাঁড় করান, যা বোগাস অজুহাত।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ৪ মার্চ ২০১৮)

তারপরও এমপি সাহেবদের চাপে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে ৩০০ সংসদীয় আসনে থোক বরাদ্দ দিয়ে গেছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সেই অঙ্কটা বাড়িয়ে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা করেছেন। উন্নয়নের নামে জনগণের অর্থের এ অপচয় আর কত দিন চলবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি