বঙ্গবন্ধু নেই, বঙ্গবন্ধু আছেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখি এবং প্রথম তাঁর বক্তৃতা শুনি ১৯৬৬ সালের মার্চে। তিনি তখন শুধুই শেখ মুজিব, এবং সিলেটের বয়স্কজনদের কাছে শেখ সা’ব। এই সম্বোধনে শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল। ছয় দফার দাবিতে তিনি তখন সারা দেশে জনমত সংগঠিত করার পরিশ্রমসাধ্য কাজটা করছিলেন। সিলেটে এলে মানুষ দল বেঁধে তাঁর কথা শুনতে গেছে। ঘরে ফিরতে ফিরতে তারা সবাই ভেবেছে, এখন দিনবদল হবে। নৌকার মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরলে ঝড়-ঝঞ্ঝাতেও তো তা তীরে পৌঁছায়।

বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ছিল সম্মোহনী। তাঁর প্রতিটি কথায় থাকত কৃষক-শ্রমিকের, দুঃখী মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস আর তাদের অধিকারের দাবি পূরণের প্রত্যয় ও নিশ্চিতির অনুরণন। সেদিনও তিনি আমাদের দেশভাগ-উত্তর বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের জানিয়েছিলেন শোষণ ও নিপীড়নের নির্মম সব কাহিনি এবং দিয়েছিলেন স্বাধিকার অর্জনের জন্য কোন পথে এগোনো উচিত, তার একটা নিশানা। আমার আফসোস, তাঁর কারাগারের রোজনামচায় ওই দিনের কোনো বর্ণনা নেই, যেহেতু দিনপঞ্জিটির শুরুই হয়েছে ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে। যদি থাকত, তাহলে তাতে কি তিনি লিখতেন শ্রোতাদের মনে তিনি কত বড় একটা অভিঘাত রেখে গিয়েছিলেন সেদিন তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে? তাঁর সুনির্দিষ্ট ওই কর্মসূচি এবং তাঁর সংকল্প ও কথার শক্তি দিয়ে? তাঁর কি তা জানা সম্ভব ছিল?

এরপর যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, স্বাধিকার আন্দোলন তখন স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু আটক, কিন্তু ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে ওই মামলা প্রত্যাহার ও তাঁর মুক্তির জন্য প্রবল আন্দোলন শুরু হয়, যাকে আমরা গণ–আন্দোলন বলে বর্ণনা করি। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লৌহমানব সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। পরদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিনি ভাষণ দিলেন, তাঁকে ছাত্ররা ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ডাকতে শুরু করল এবং তাঁর নেতৃত্বে আমাদের এগিয়ে যাওয়াটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল।

বাকি ইতিহাসটা মানুষই লিখে নিয়েছে দ্রোহের, প্রতিরোধের, আত্মত্যাগের মহিমা জড়ানো পটে। মাত্র তিন বছরেই যে দেশটা স্বাধীন হবে, তা অনেকের জন্য অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা জানত আমাদের ইতিহাসটা ওই গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে গিয়ে আমি এবং আমার বন্ধুরাও নিশ্চিত হয়েছিলাম, ঝড়-ঝঞ্ঝাটা প্রবল হবে, কিন্তু আমাদের ইতিহাসের নৌকাটা তীরে পৌঁছাবে, যেহেতু অবিচল হাতে তার হাল ধরে আছেন বঙ্গবন্ধু।

৭ মার্চের ভাষণটা আমাকে ভাবিয়েছে। এর একটা জায়গায় এসে আমি এখনো ভাবি, মানুষকে এই বার্তাটা কেন দিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার সংগ্রামটা আমরা শেষ করে ফেলেছি যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ আমরা উজ্জ্বল করে দিলাম আমাদের পতাকার রঙে। কিন্তু মুক্তি?

এই মুক্তি কি শুধু পরাধীনতার অর্গল থেকে মুক্তি? শোষণ, বঞ্চনা আর অর্থনৈতিক পরাভব থেকে মুক্তি? নাকি একটি উপনিবেশি, অনাধুনিক, ব্যক্তিবিনাশী অচলায়তন থেকে মুক্তি? এই মুক্তি কি রবীন্দ্রনাথের ‘আলোয় আলোয় এই আকাশে,’ ‘সর্বজনের মনের মাঝে’? আমার শোনা বঙ্গবন্ধুর প্রথম বক্তৃতায় তাঁকে আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, ‘আমার মানুষের মুখে হাসি নাই।’ গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনাটাকে কি তাহলে আমার শোনা তাঁর শেষ বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন মুক্তি?

কারাগারের রোজনামচা আমার হাতে এলে এর নানা পৃষ্ঠার মার্জিনে দাগ দিয়ে, মন্তব্য লিখে, যেদিন আমার পড়া শেষ হলো, আমার মনে হলো আমার প্রশ্নগুলোর একটা উত্তর আমি পেয়েছি। দিনপঞ্জিটি বঙ্গবন্ধু লিখেছেন কারাগারে বসে, যেখানে নিশ্বাসটা পর্যন্ত তাঁর নিতে হতো পরাধীন বাতাসে। পাকিস্তানের শাসনটাকে তিনি দেখেছেন একটি উপনিবেশি ব্যবস্থা হিসেবে, স্বাধীনতাকে দেখেছেন সেই উপনিবেশ থেকে মুক্তি হিসেবে। কারাগারের রোজনামচা পড়লে বোঝা যায়, তিনি শুধু রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশ–মুক্তির কথা ভাবেননি, ভেবেছেন মনের উপনিবেশ–মুক্তির কথাও। রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও মনের ভেতর থানা গেড়ে বসে থাকা উপনিবেশটা হাওয়া হয়ে যায় না। এটিকে তাড়াতে হয়। ‘সর্বজনের মনের মাঝে’ মুক্তির স্বাদটা না পৌঁছানো পর্যন্ত এটি টিকে থাকে।

কারাগারের রোজনামচায় এ জন্য তিনি চিন্তার মুক্তির পক্ষে লিখেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা কেন নেই, সেই আক্ষেপ করেছেন। আইনের শাসন চেয়েছেন, দুঃখ করে লিখেছেন, ‘যিনি আইনশৃঙ্খলার মালিক হয়ে আইনশৃঙ্খলা ভাঙতে উসকানি দিতেছেন, তার বিচার কে করবে?’ সমালোচনা করার অধিকারের কথা লিখেছেন, ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘কেউ সমালোচনামূলক যে কোনো কথা বলুন না কেন মামলা দায়ের হবে।’ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তিনি লিখেছেন, ‘বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কি করতে পারি!’ এই আক্ষেপের উল্টো পিঠে যা লেখা আছে তা হলো মুক্ত হলে এই মঙ্গল সুনিশ্চিত করার সংগ্রামটা চালিয়ে যাব। জনগণের মঙ্গলের জন্য সংগ্রামটা জোরালো করার কথা তিনি সত্তরের নির্বাচনের আগে বলেছেন, একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য তাঁর নতুন সংগ্রামের কথা পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছে বলেছিলেন।

কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি শুধু অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নয়, এর ভিত্তি সর্বজনের মনের মুক্তি। সেই মুক্তির সাক্ষাৎ বাঙালি কবে পাব?

 ২.

আমি জানি না, বঙ্গবন্ধুর দলের নেতা–কর্মীরা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা পড়েছেন কি না; সময় নিয়ে, মার্জিনে মন্তব্য লিখে, পড়েন কি না। পড়লে তো তাঁদের দেশটার দিকে একবার তাকাতে হতো। এবং বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে এর যাত্রা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁদের পথে নামতে হতো। তা কি হচ্ছে? বরং এই দেশে কি বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপগুলো এখন দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হয় না? এই দেশে কি সততা পুরস্কৃত হয়, নাকি নানা সিন্ডিকেটের অসৎ চক্রের হাতে সততা মার খায়? এই দেশে বিপন্ন মানুষের জন্য দেওয়া ত্রাণসামগ্রী থেকে শুরু করে ব্যাংকের টাকা আর রাষ্ট্রের সম্পদ লোপাট হয় অথচ লোপাটকারীরা শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে হাসতে হাসতে ব্যাংকে যায়। এই হাসতে হাসতে দেশ-বিদেশের ব্যাংকে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। স্বাধীন চিন্তার বৃত্তটার পরিসর বাড়তে থাকার পরিবর্তে সংকুচিত হচ্ছে। আইনের শাসনের মালিকানা যাচ্ছে পরাক্রমশালীদের হাতে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে কোনো দিন বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ রাষ্ট্রের দরজায় পৌঁছা দূরের কথা, তার ঠিকানাই খুঁজে পাব কি না সন্দেহ।

৩.

আজ বঙ্গবন্ধুর চলে যাওয়ার পঁয়তাল্লিশ বছর হলো। এই দিনে তাঁর অনুপস্থিতিটা বড় হয়ে সামনে আসার কথা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, অনুপস্থিতির চাইতে তাঁর উপস্থিতিটাই প্রবল হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ বছর আমরা তাঁর জন্মের শতবর্ষ পালন করছি। এটি তাঁর উপস্থিতির উদ্‌যাপন।

তিনি আছেন। তিনি আমাদের একাত্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবারও আমাদের মুক্তির যাত্রায়—যেদিনই তা শুরু হোক—তিনি আমাদের সামনে থাকবেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ