বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে গাছ লাগানো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের নানামুখী আয়োজনের মধ্যে দেশব্যাপী এক কোটি গাছের চারা রোপণ ও বিতরণের কর্মসূচি সরকারের পূর্বনির্ধারিত একটি বিষয়। ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এ কর্মসূচির কথা বলেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৬ জুন গণভবন প্রাঙ্গণে চালতা, ছাতিম ও তেঁতুলগাছের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি যথার্থ। কারণ, স্বাধীন দেশে গাছ লাগানো ও বন সংরক্ষণের মতো জরুরি বিষয়গুলো তিনি সবার আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন করে সুন্দরবনের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তৃতা করেছিলেন। একই বছর তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে জুয়া খেলা বন্ধ করে নারকেলগাছের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে একটি উদ্যানের উদ্বোধন করে উদ্যানটির নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭৪ সালে বৃক্ষরোপণ অভিযান উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে তিনি বলেন, ‘...সরকারি বনাঞ্চলবহির্ভূত এলাকায় জনসাধারণের সহযোগিতায় অধিক গাছ লাগিয়ে বৃক্ষসম্পদ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে।...দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য এই বৃক্ষরোপণ অভিযানের সময় এবং পরে অধিক বৃক্ষরোপণ করে সরকারের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা।’

 সারা দেশে এখন কোভিড–১৯ মহামারি চলছে। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ঘিরে এক কোটি গাছের চারা রোপণ ও বিতরণের কর্মসূচিতে কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। তা ছাড়া যথাযথভাবে এক কোটি গাছের চারা রোপণ ও বিতরণ খুব সহজ কাজও নয়। আমাদের প্রত্যাশা, কাজটি অতীতের মতো দায়সারা ধরনের হবে না। কারণ, এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটি জড়িয়ে আছে। কাজটি আরও ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য ২০২১ সালকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। মৌসুম শেষে বাকি গাছগুলো আগামী বছর রোপণের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। তার সঙ্গে অবশ্যই থাকবে জাতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা ও পরিচর্যার বিষয়টি। কারণ, পরিচর্যাহীন এক কোটি গাছের চারা প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপও হয়ে উঠতে পারে।

২.

২৬ জুলাই প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘সড়কজুড়েই ক্ষতিকর আকাশমণি, দরপত্রে ছিল না।’ এই অপকর্ম রাজশাহী–নওগাঁ সড়কের। সড়ক উন্নয়নের নামে বীথিবদ্ধ তালগাছ ও আমগাছ কেটে সেখানে আকাশমণির জঞ্জাল লাগানো হচ্ছে। অথচ দরপত্রে রাস্তার পাশে শোভাবর্ধনকারী, বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ লাগানোর কথা ছিল। সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনায় বৃক্ষরোপণের কিছু নিয়ম-পদ্ধতি আছে। সব গাছ সব জায়গার জন্য উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া সঠিকভাবে গাছ লাগাতে একদিকে যেমন পরিকল্পনা প্রয়োজন, অন্যদিকে এটি একটি শিল্পও। এ কাজে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রয়োজন, যা একজন ঠিকাদারের কাছে আমরা আশা করতে পারি না। আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস ও মেহগনি কীভাবে এবং কেন দেশের সরকারি নার্সারিগুলোর প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠল, সেই প্রশ্ন আমরা বরাবরই করেছি। আমাদের বন-পাহাড়ে নানা প্রজাতির উন্নত মানের দারুবৃক্ষ থাকা সত্ত্বেও বন বিভাগ কেন এসব ভিনদেশি গাছের চারা উৎপাদন ও রোপণ নিয়ে মেতে আছে, তা এক বিরাট রহস্য। পাহাড়ের সব উদ্ভিদ ধ্বংস করে সেখানকার হাজার হাজার একর বনভূমিতে যে রাবার চাষ করা হলো, সেই রাবার আমাদের জাতীয় অর্থনীতির সূচককে কতটা ওপরে তুলতে পারল, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কি সরকারের হাতে আছে? একই জিজ্ঞাসা আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস ও মেহগনির ক্ষেত্রেও। যঁারা এখানকার প্রাকৃতিক উদ্ভিদের সম্ভাবনা ও চাষপদ্ধতি নিয়ে কোনো প্রায়োগিক গবেষণা না করে ভিনদেশি জঞ্জাল এনে দেশ সয়লাব করছেন, তাঁরা আসলে কাদের স্বার্থ দেখছেন? কয়েক দিন আগেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশের কোনো জায়গা এখন আর অনাবাদি থাকবে না। তাহলে এই অপরিকল্পিত রাবার বনগুলোর এখন কী হবে?

৩.

ঢাকায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মূল ফটক লাগোয়া সড়ক বিভাজক এবং বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়কের বিভাজকে এ বছরও কৃষ্ণচূড়াগাছ লাগানো হয়েছে। দেখে মনে হয়েছে গাছগুলো ব্যক্তিগত উদ্যোগে লাগানো। ঝড়ের সময় সহজেই যে কটি গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে বা উপড়ে যায়, কৃষ্ণচূড়া তার মধ্যে প্রধানতম। এ কারণে সড়ক বিভাজক বা ফুটপাতের জন্য গাছটি মোটেও আদর্শ শ্রেণির নয়। এ কথা আমরা বহুবার বলেছি। বৃক্ষায়ণের ক্ষেত্রে এসব অপরিকল্পিত উদ্যোগ বন্ধ করতে হলে বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যা ও পরিকল্পনার জন্য জাতীয় পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা প্রয়োজন। এই কমিটির সদস্য হবেন একেবারে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞ উদ্ভিদকর্মীরা; কোনো আলংকারিক উপাধিসর্বস্ব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়। আশা করি অচিরেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে উদ্ভিদ রক্ষা, রোপণ ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব