কাছে থেকে দেখা মার্চ '৭১

মার্চ ১৯৭১: স্বাধীনতার দাবিতে শিল্পীরাও রাজপথে নেমে এসেছেন
মার্চ ১৯৭১: স্বাধীনতার দাবিতে শিল্পীরাও রাজপথে নেমে এসেছেন

প্রকাশিতব্য সংকলন গ্রন্থ অবরুদ্ধ ঢাকায় মঈদুল হাসানের যে লেখাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার অংশবিশেষ এখানে ছাপা হলো।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলাকে পুরোপুরি সামরিক কর্তৃত্বের অধীনে আনে। কিন্তু পূর্ব বাংলায় তাদের হাতে যে পরিমাণ সেনা ছিল, তা গণবিস্ফোরণ দমনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। আকাশপথে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা এনে এবং সমুদ্রপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ নানা ধরনের সামরিক যান পাঠিয়ে আর শহরের বিভিন্ন স্থানে শক্ত অবস্থান নির্মাণ করে তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে
চলে। অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনের গতিও দ্রুত বাড়ছিল। এর কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায় যখন ৬ মার্চ প্রাদেশিক জনপ্রশাসনের সদস্যরা নির্বাচিত দলের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁদের পেশাদারির সাহায্যে এই আন্দোলন এক সমান্তরাল সরকারের রূপ দেয়। কিন্তু তার পরও এটা ছিল অহিংস আন্দোলন। নেতৃত্বের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি জনগণকে সশস্ত্র না করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন কিংবা সশস্ত্র শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ বাঙালি অংশের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১০ বা ১১ মার্চ সন্ধ্যায় আমার বাসায় এলে তাঁর সঙ্গে আমার একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়। তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। কারণ, তারা আগের মতোই সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছিল। তিনি মূলত আমার কাছ থেকে জানতে এসেছিলেন, কোনো কূটনৈতিক সূত্র থেকে আমি কিছু জানতে পেরেছি কি না; বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের বিরোধ মিটমাট করার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছি কি না। আমাদের ৫ মার্চের বৈঠকের পর থেকেই এই ধারণাটি মনে হয় তাঁকে তাড়িত করছিল।
আমি জানি না, তিনি তাঁর দলের ভেতর থেকে বা অন্য কোথাও থেকে এ রকম কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিলেন কি না। আমি কিছুটা কৌতুক করেই তাঁকে বলেছিলাম, তিনি তাঁর নেতার কাছ থেকে কেন বিষয়টি নিশ্চিত করছেন না। কেননা শেখ মুজিব ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন। আমি ইতিমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত চেকোস্লোভাকিয়ার কনসাল জেনারেল ড. ড্যালিবর ক্রুলিস ও সোভিয়েত দূতাবাসের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) ইউরি পেত্রোভের মতো দুই ওয়াকিবহাল কূটনীতিকের কাছে ব্যাপারটি জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু
তাঁরা কেউ কিছু জানতেন না। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদকে আমি আরও জানাই ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, অন্যান্য কিছু ইউরোপীয় দেশ ও জাপান তাদের কনস্যুলেটের লোকজনদের এখান থেকে জরুরিভাবে বিমানে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এতে অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, তা তাদের আচরণ থেকে স্পষ্ট। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তানের তৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আগাম সামরিক আঘাত করার যে প্রস্তাবটি ছিল, তা আপনারা নতুন করে খতিয়ে দেখবেন কি না? আমার বাসার লনের সেই মৃদু আলোয় তিনি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তাঁদের এটা করা উচিত, তবে এটা তাঁর ক্ষমতার বাইরে।
৭ মার্চের পরবর্তী সপ্তাহে ছয় দফার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বদলে এক দফার দাবি অর্থাৎ স্বাধীনতার অঙ্গীকারসহ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকল। দেশের দুই অংশের মধ্যে সব রকম যোগাযোগ কার্যত বন্ধই হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী পশ্চিম পাকিস্তানি ধনী ব্যক্তিদের দেশ ছাড়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। ইয়াহিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পেল। ফলে প্রতিদিনই নতুন নতুন গুজব ও তত্ত্ব তৈরি হতে থাকল। শেষে প্রায় বিনা ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরদিন থেকে ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। পরবর্তী ছয় দিন তাঁদের বৈঠক চলতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ আর কিছুটা বিদ্ঘুটে
হয়ে পড়ে। শীর্ষ পর্যায়ে আপস-মীমাংসার জন্য আলাপ-আলোচনা চলছিল। আবার অসহযোগ আন্দোলনও অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে স্থানে স্থানে সংঘর্ষ চলছিল। প্রতিদিনই নতুন নতুন সেনা আকাশপথে আসছিল। কূটনীতিকদের দেশ ছাড়ার হারও বেড়ে চলছিল। শহরের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা নতুন নতুন চৌকি আর ক্ষুদ্র বাংকার তৈরি করছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ে যে চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ এসে পৌঁছেছে। বেসামরিক প্রতিরোধের কারণে সেগুলো খালাসের অপেক্ষায় আছে।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে যেসব সামরিক অধিনায়ক ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে অনেকের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। কারণ, রাজনৈতিক আপসরফায় তাঁদের ভূমিকা ছিল না। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি ইউনিটগুলোকে (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে দূরবর্তী স্থানগুলোতে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের প্রথম পাঁচ-ছয় দিনে বাইরে থেকে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। ২১-২২ মার্চ জোর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) হলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতাদের চাপে কেন্দ্রীয় সরকারে অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে অবস্থান পাল্টিয়ে মুজিব অনতিবিলম্বে কনফেডারেশনের জন্য চাপ দিচ্ছেন।
এমন সময় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে যেতে পারে—এই সম্পর্কিত শঙ্কাটি হঠাৎ ২২ মার্চ দূরীভূত হয়। ছয় বা সাতটি বৈঠকের পর সংশয়ী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুজিব জোর দিয়ে বলেন, যথেষ্ট অগ্রগতি না হলে তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যেতেন না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অত্যুৎসাহে দাবি করেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাদের কনফেডারেশনের প্রস্তাব প্রায় মেনে নিয়েছে। পরদিন ২৩ মার্চ ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিশাল যৌথ সমাবেশে শেখ মুজিব বলেন, যে নেতা বিনা রক্তপাতে তাঁর দাবি আদায় করতে পারেন, তিনিই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ নেতা। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি বা তাঁর নিজের কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি। কিন্তু তাঁর এ কথায় পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল যে সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং তা শুধু স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। এসব বিবৃতি দেশের প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্রে ২৪ মার্চ প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এসব খবর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে আলোকিত অংশকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান তখন গুলশানের উত্তর সীমান্তে থাকতেন। আমার বাসা ছিল গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের পেছন দিকে। ২৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে তিনি আমার বাসায় এসে এক ঘণ্টা পর তাঁর বাসায় রাতের খাবারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।
আমি সেখানে পৌঁছে দেখি ড. কামাল হোসেন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর টোকিও প্রতিনিধিকে (তাঁর নাম সম্ভবত সেলিগ হ্যারিসন) দেশের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তাঁর দলের অবস্থান জানাচ্ছেন। কামাল হোসেন ছিলেন আলোচনা কাজে শেখ মুজিব কর্তৃক নিয়োজিত দুই সর্বোচ্চ প্রতিনিধির মধ্যে একজন, যাঁরা ইয়াহিয়া খানের পক্ষের আলোচকদের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে কনফেডারেশনের ঐকমত্যের খসড়া প্রস্তুত করছিলেন।
তখনকার বিপরীতধর্মী চিত্র লক্ষ করে আমি বিশাল ধাঁধায় পড়ে যাই। একদিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সামরিক প্রস্তুতি বৃদ্ধি, অন্যদিকে চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও ঢাকার উপকণ্ঠ মিরপুরে সেনাবাহিনী ও অবাঙালিদের (বিহারি) সঙ্গে বাঙালিদের সংঘাত। এ সংঘাত তখন হঠাৎ বেড়ে যায়। আবার সরকারের মতিগতি পরিবর্তনের ফলে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের অগ্রগতির খবরও প্রচারিত হয়। এ দুই বিপরীতধর্মী খবরের মাঝে পড়ে হতবুদ্ধি হওয়ার মতো অবস্থা আমার।
এর আগে ২২ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ওয়ালী খান আমার বাসায় এসেছিলেন। সেদিন তিনি আমাকে ও আমার অভ্যাগতদের যা বলেন, সেটা শুনে পুরো ব্যাপারটি আমার জন্য আরও গোলমেলে হয়ে যায়। তিনি বলেন, সেদিন সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি (ইয়াহিয়া) যে অবস্থায় পৌঁছেছেন সেখান থেকে বেরোনোর জন্য কোন পথে এগোতে চান। জবাবে ইয়াহিয়া সরাসরি বলেন, তাঁর একটি পথই তো খোলা, আর তা হচ্ছে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাওয়া। ওয়ালী খান আরও বলেন, মুজিবকে তিনি ইয়াহিয়ার এই উক্তি সঙ্গে সঙ্গেই অবহিত করেছেন।
ওয়ালী খান পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক কিংবদন্তি নেতার ছেলে। তিনি নিজেও সত্যনিষ্ঠ অকপট পাঠান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরস্পরবিরোধী এই দুই অবস্থানের মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে আমি আওয়ামী লীগের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কামাল হোসেনের কাছ থেকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানার সুযোগটি গ্রহণ করি।
রেহমান সোবহানের বাসায় সেদিন যখন কামাল হোসেন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর টোকিও প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন সেখানে সালমা সোবহান ও হামিদা হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সংবাদদাতাকে আশা ও উদ্দীপনামূলক কথা শোনানো হলো। সেনাবাহিনীর উগ্র মহলের কারণে পরিস্থিতি অনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সর্বশেষ প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া ইয়াহিয়ার আর কোনো পথ নেই। তাঁকে সামরিক আইন তুলে নিতে হবে, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অবশ্য ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার সাময়িকভাবে পরিচালিত হতে পারে। ইতিমধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় সংসদকে প্রাদেশিক ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।
কামাল হোসেনের কথা অনুযায়ী এই সবকিছুর ভিত্তিতে আর এক-দুই দিনের মধ্যেই ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কামাল হোসেনকে আমি আওয়ামী লীগের একজন মেধাবী নেতা বলেই মনে করতাম। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর পরিস্থিতির মূল্যায়নকে আমি গ্রহণ করতে পারিনি। বরং দলের প্রধানের আশাবাদে তাঁকেও এভাবে ভেসে যেতে দেখে কিছুটা বিরক্ত হই। পুরোটা সময় আমি বিস্ময়ে নিশ্চুপ ছিলাম। কিন্তু সেই সংবাদপত্র প্রতিনিধি পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার মত জানতে চেয়ে চাপাচাপি করলে আমি অবশেষে মুখ খুলি। আমার ভেতরে জমে ওঠা বাষ্প বের করে দিয়ে বলি, পরিস্থিতি সম্পর্কে যা শুনলাম তা এ রকম, একটা লোক এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে সবেগে নিচে পড়ে যাচ্ছে, পড়তে পড়তে মাটির কাছাকাছি একটি তলার এক জানালায় একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলছে, ‘সো ফার সো গুড!’ (এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছে)
কিন্তু ২৪ মার্চেই সমঝোতার বিষয়ে ইয়াহিয়ার দেওয়া আশাবাদ দৃশ্যমানভাবে ফিকে হয়ে আসে যখন, শেখ মুজিব সংবাদপত্রকে আবার বলেন যে তিনি শিগগিরই কোথায় থাকবেন তা তিনি জানেন না, কিন্তু সংগ্রাম অবশ্যই চলবে। আমার মনে হয়েছিল, কিছু অজানা বিষয় তাঁর বিচারবুদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। আর তাঁর নিজস্ব বিচার-বিবেচনাই দলের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করত। আমার এ রকম সংশয়ের সত্যতা খুঁজে পাই সত্তর দশকের শেষ ভাগে, যখন অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার একটি কপি হাতে পাই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সেই আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ১৮ মার্চ। সেটির একটি করণীয় অংশ থেকে এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘উচ্চতর পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। এমনকি মুজিবকে ধোঁকাও দেওয়া যেতে পারে। মানে ভুট্টো রাজি না হলেও রাষ্ট্রপতি ২৫ মার্চ তারিখে ঘোষণা করবেন যে তিনি আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়েছেন।’ (সূত্র: সিদ্দিক সালিক: উইটনেস টু সারেন্ডার, পৃষ্ঠা ২২৮)
এই ধোঁকা দেওয়ার পরিকল্পনা স্পষ্টতই কার্যকর হয়েছিল। ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতারা কনফেডারেশনের নীতিমালার চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আমন্ত্রণের জন্য সারা দিন ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান চুপিসারে সন্ধ্যাবেলা ঢাকা ত্যাগ করেন। সম্পূর্ণ হতবিহ্বল পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের নিরস্ত্র জনগণের বৃহত্তম আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে; শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

মঈদুল হাসান: মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।