অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ অবস্থার অবসান চাই

পাহাড়ি জনপদ আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে। ভূমি কমিশনের সুপারিশ এবং সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সমঅধিকার আন্দোলন, পার্বত্য-বাঙালি ছাত্র পরিষদ, এসব সংগঠনের ব্যানারে লাগাতার অবরোধ-হরতাল হলো তিন পার্বত্য জেলায়। আন্দোলনকারীদের মধ্যে সব দলের লোকই আছেন—আওয়ামী লীগার, জাতীয়তাবাদী, জামায়াতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভেদের দেয়ালটা ক্রমেই চওড়া হচ্ছে, আর পালে বাতাস দিচ্ছে সরকারের ভেতরের এবং বাইরের নানা অপশক্তি।
১৯০১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করত। ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ১ দশমিক ১১ শতাংশে পৌঁছায়। ১৯৭৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৯৬ শতাংশ, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়েছে ২২৭ শতাংশ, অর্থাৎ সোয়া তিন গুণেরও বেশি। এটা কেমন করে সম্ভব হলো? উত্তর একটাই, অন্যান্য জেলা থেকে এখানে অনেক মানুষ এসেছে। এর ফলে এখানে সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
পাহাড়ের অধিবাসীরা সমতলে চাষবাস করতে জানত না। চাকমা রাজা ধরম বখশ খাঁ ১৮১৮ সালে চন্দ্রঘোনা থেকে কয়েকটি বাঙালি মুসলমান কৃষক পরিবারকে রাঙামাটিতে নিয়ে আসেন। সেই থেকে শুরু। ওই সময় ব্যবসা ও চাকরি সূত্রে অনেক বাঙালি এই অঞ্চলে এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। কিন্তু সত্তরের দশক থেকে এই অভিবাসন-প্রক্রিয়া নতুন মাত্রা পায়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বসতি স্থাপনের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এখানে বাঙালিরাই সংখ্যাগুরু। বিশেষ করে, খাগড়াছড়ি জেলায় তো তাদের সংখ্যা প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ।
১৯৯১ সালের আদমশুমারির পর নৃগোষ্ঠীভিত্তিক জনসংখ্যার তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো আর দিচ্ছে না। গণপরিষদে এই অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১০টি গোষ্ঠীর উল্লেখ করেছিলেন। ইউএনডিপির উদ্যোগে যে নমুনা জরিপ হয়েছিল ২০০৮ সালে, সেখানে ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ন্যূনপক্ষে ১৪টি। এরা হচ্ছে বম, চাক, চাকমা, খিয়াং, খুমি, লুসাই, মারমা, ম্রো, পাংখুয়া, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, অসমিয়া, গুর্খা ও সাঁওতাল। মুশকিল হচ্ছে, বড় নৃগোষ্ঠীগুলো ছোটগুলোর অস্তিত্ব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অনেক মিথ চালু আছে। অনেকেই মনে করেন, এখানে বুঝি সবাই জুমচাষ করেন। কথাটা বেঠিক। জুমচাষির সংখ্যা বর্তমানে ২২ হাজারের কিছু বেশি। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশের মূল জীবিকা হলো জুম। যাঁদের টাকা আছে (পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে), তারা প্রচুর বিনিয়োগ করে ফলের বাগান করছেন, অথবা বনজ গাছের বাগান তৈরি করছেন। সমতলের জমি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় এবং অতি চাষে পাহাড়ের মাটির গুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জুমচাষিরা এক-দুই বছর পর পরই একই জমিতে ফিরে আসছেন চাষের জন্য। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। যেসব ফসল চাষ করলে মাটি ক্ষয় হয় (যেমন আদা, হলুদ, কচু), সেগুলোর বাণিজ্যিক চাষের ফলে ভূমিক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে। সত্যিকার জুমচাষিরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। জুম তাঁদের সারা বছরের খাবারের জোগান দেয়। কিন্তু কেউ কেউ প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিপদ ডেকে আনছেন।
গত তিন-চার দশকে যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে, তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র। এদের অনেককেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে পুনর্বাসনের নামে। তাদের পরিবারপিছু পাঁচ একর করে জমি দেওয়া হয়েছে। এরা অনেকেই জানে না, ওই জমি কোথায়, তার কী চৌহদ্দি। পাহাড়ে চাষবাসের কোনো অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস তাদের নেই। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তারা অনেকেই গৃহবন্দীর মতো জীবন কাটাচ্ছে। সুযোগসন্ধানীরা তাদের অনেক সময় ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিকীকরণ শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এর আগে এই এলাকা ছিল মিজো বিদ্রোহীদের অভয়ারণ্য। বিদ্রোহী মিজোর নেতা লালডেংগা সপরিবারে রাঙামাটিতে বাস করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি চলে যান। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘বিদ্রোহী’দের নির্মূল করার সামরিক অভিযানটি বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করে ১৯৭২ সাল থেকেই। এই অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ভারতের এসএসএফের প্রধান মেজর জেনারেল উবান। তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (পরবর্তী সময়ে নাম বদলে হয় মুজিববাহিনী) গঠন-প্রক্রিয়ায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁকে বিশেষ উপদেষ্টার মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘শত্রুমুক্ত’ করার মিশনের দায়িত্ব দেন। ওই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলা হয়। এর বিরুদ্ধে গণপরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। চুয়াত্তর সালের ২৮ জুন অর্থ বিলের ওপর এক বিতর্কে তিনি বলেছিলেন:
‘অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জায়গা—দীঘিনালা, রুমা ও আলীকদমে তিনটি সেনানিবাস তৈরি করা হচ্ছে এবং বান্দরবানের সোয়ালকে আরও একটি তৈরি করা হবে। এ ছাড়া রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বিডিআর উইং হেডকোয়ার্টার তৈরি করা হবে। জানি না, কিসের জন্য সেখানে এত সেনানিবাস তৈরি করা হচ্ছে।...সেখানে চাষাবাদ করার মতো জমি খুব কম, অথচ সেই জমি দখল করে নিয়ে সেনানিবাস তৈরি করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন ছয়টি পূর্ণাঙ্গ সেনানিবাস আছে।’
মানবেন্দ্র লারমা ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য। সমঝোতার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিদান দেয়নি। তিনি সামরিক সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে, অনেক আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির একটি চুক্তি হয়। এর শিরোনামে ‘শান্তি’ শব্দটি ছিল না, যদিও এটা শান্তিচুক্তি হিসেবেই পরিচিতি পায়। জনসংহতি সমিতির সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি।
দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, এই চুক্তির সরাসরি বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রশাসনের মনস্তত্ত্বও একই রকমের। তাই গত ১৫ বছরেও এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক আদিবাসী মনে করেন, বাঙালি-পাহাড়ি বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে গোষ্ঠীগত স্বার্থে। তাঁরা অনেকেই ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে শ্লাঘা অনুভব করেন না। তাঁরা মনে করেন, হয়তো বা কেউ বাঙালি, কেউ চাকমা, কেউ মারমা কিংবা ত্রিপুরা। ‘আদিবাসী’ কোনো নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নয়। এটা নিয়ে অনেক বাঙালি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আদতে ক্ষতি করছেন পাহাড়িদের। মূল বিরোধটা হলো সমাজের গণতন্ত্রায়ণের, পাহাড়ে আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে বংশপরম্পরায় যে সামন্ত প্রথা টিকিয়ে রাখা হয়েছে, তাও সমীচীন নয়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ জমির মালিক নয়। তারা ঐতিহ্যগতভাবে জুমচাষ করে। মৌজাপ্রধান (হেডম্যান) ও পাড়াপ্রধান (কার্বারি) ঠিক করে দেন কোন বছর কে কোথায় চাষ করবে। এ ব্যবস্থার সামাজিক উপযোগিতা আছে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় তাদের যদি জমি চিরস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমস্যার অনেক সমাধান হবে। তাদের আর সামন্ত প্রভুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। এটা ঠিক, অনেক পাহাড়ি জমি হারিয়েছেন। একসময় হাজার হাজার পাহাড়ি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন, তাঁদের অনেকের ভিটেমাটি অন্যের দখলে। এই দখলমুক্ত করার প্রয়াসটা তেমন চালানো হয়নি। এটা হলে দখলদারেরা বিক্ষুব্ধ হবেন, যাঁদের একটা বড় অংশই সাম্প্রতিক অভিবাসী, বাঙালি। ভূমি কমিশন এখানে হাত দিয়েছে। তাতেই সংক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে উন্নয়নের অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশে যেখানে মাছের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি তিন থেকে ছয় টন, কাপ্তাই লেকে তা মাত্র ১০০ কিলোগ্রাম। কী বিশাল অবহেলা, অপচয় ও চুরি! এখানে পরিকল্পিত উপায়ে মিশ্র ফলের ও মসলার বাগান করলে তা পুরো দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। এ জন্য দরকার প্রচুর বিনিয়োগ এবং তার জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে ‘শান্তি’।
একটা সশস্ত্র আন্দোলন যখন যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছায় না, তখন শুরু হয় দলবাজি, গুপ্তহত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ইত্যাদি। সারা দেশেই এখন এটা চলছে। এই নষ্ট রাজনীতি গ্রাস করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামকেও। যেখানে যুযুধান তিনটি সশস্ত্র গ্রুপ একে অন্যের সংহারে সদা ব্যস্ত। এ অবস্থা চলবে কত দিন, কে জানে। যত দিন এ রকম অশান্ত অবস্থা থাকবে, তত দিন সেখানে সামরিক উপস্থিতির পক্ষে যুক্তিও থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই পরিস্থিতি এক দিনে হয়নি। মেজরিটি শভিনিজমের বলি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। অনেকের মতে, এটা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনার সূচনা হয়েছিল, রাষ্ট্রের আন্তরিকতার অভাবে তা নষ্ট হতে চলেছে। এখনো সময় আছে সংকট থেকে উত্তরণের। প্রয়োজনে ওই চুক্তির আরও পর্যালোচনা হতে পারে। মূল বিষয়টা হলো পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনা। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]