দুই পারে দুটি রাস্তাই আপাতত পাওয়া!

পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের মেয়াদে সেতুর কাজ শুরু করা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে (‘সরকারের মেয়াদে কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয়’, ২৭ জুন, প্রথম আলো)। আর এ নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রীকেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেল (‘ডিসেম্বরের মধ্যে কাজের অর্ডার দিতে পারব কি না সন্দেহ রয়েছে’—অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের সন্দেহকে মানতে পারেননি যোগাযোগমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের জবাবে যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি জিনিয়াস মানুষ, ভালো মানুষ। তবে বয়স হয়েছে, মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন’)।

এই বিতর্ক আমাদের এমন ধারণা দিচ্ছে যে সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বা সব ঠিক পথেই চলছে। এখন কবে মাটি কেটে মূল সেতুর কাজ শুরু হবে, বর্তমান সরকারে মেয়াদে হবে কি না, এটাই শুধু মতভেদ বা তর্কবিতর্কের বিষয়। কিন্তু সমস্যাটি আসলে দুই দিন আগে বা পরে সেতুর কাজ শুরুর বিষয় নয়; এই সেতু বানাতে কোনো যোগ্য প্রতিষ্ঠান আদৌ আগ্রহী হবে কি না, সেটাই সম্ভবত এখন সবচেয়ে বড় সংশয় ও অনিশ্চয়তার জায়গা।

পদ্মা সেতু তৈরির জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সেতু বিভাগ গত বছর এই নির্বাচনের কাজটি করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত চীনের একটি প্রতিষ্ঠানকে (সিসিসিসি) বর্তমান দরপত্রের প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে (যদিও পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন বিশ্বব্যাংকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই)। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের অংশ হিসেবে বাকি চারটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র কেনা এবং তা জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে বাস্তবতায় এই চারটি প্রতিষ্ঠান একসময় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পেতে আগ্রহী ছিল, সেই বাস্তবতা বা পরিস্থিতি কি এখনো বজায় রয়েছে?

এই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন পদ্মা সেতু নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। বিষয়টি শুধু আর্থিক নিশ্চয়তার বিষয় নয়, যেকোনো প্রকল্পে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকা মানে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা বেড়ে যাওয়া। কারণ, অর্থ জোগান দেওয়ার পাশাপাশি বড় প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও তদারকির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে কারিগরি দক্ষতা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে। যেকোনো আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের তদারকি বা পর্যবেক্ষণের অধীনে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বর্তমান বাস্তবতা তাই আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে নয় বলেই মানতে হচ্ছে।

পদ্মা সেতু একটি বড় প্রকল্প। এটি বানাতে যে টাকাপয়সা লাগবে, তার পুরোটার জোগান আছে—এমন অবস্থাতেই শুধু একটি বড় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করতে চাইবে। আগে একটি লেখায়ও প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলাম। ‘যেকোনো বড় প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য এর পুরো অর্থ কোথা থেকে এবং কীভাবে আসবে ও খরচ হবে (টেকনিক্যাল ভাষায় যাকে পূর্ণাঙ্গ “ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে), তা চূড়ান্ত করা অবশ্যকরণীয় একটি বিষয়’ (প্রথম আলো, ৮ মার্চ, ২০১৩)। বাজেটে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব বা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার আলাদা করে রাখার ঘোষণাকে আর যাই হোক, পূর্ণাঙ্গ ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজ বা প্রকল্পের চূড়ান্ত আর্থিক নথি হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এ ধরনের কিছু ছাড়া কোনো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করার ঝুঁকি নিতে যাবে কেন?

যোগ্যতার প্রথম পরীক্ষায় পাস হওয়া এই চারটি প্রতিষ্ঠান একবার কাগজপত্র তৈরির পেছনে যথেষ্ট অর্থ খরচ করেছে (বিশ্বব্যাংক যুক্ত থাকায় তখন আর্থিক নিশ্চয়তা ছিল)। এখন অর্থের জোগান নিয়ে যেহেতু অনিশ্চয়তা, তাই দরপত্র কেনা এবং দরপত্রের কাগজপত্র বানানোর জন্য নতুন করে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হবে এমন আশা করা কঠিন!

পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে জল-পানি সবই গড়িয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেই অভিযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকসহ বড় দাতাদের সরে যাওয়া, কানাডায় দুর্নীতির অভিযোগে মামলা, দেশে দুদকের মামলা, যোগাযোগমন্ত্রীর বিদায়—এসব ঘটনা এই প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যাতে আন্তর্জাতিক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা ফিরে আসতে পারে।

দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যেখানে বিশ্বব্যাংক নিশ্চিত, সেখানে সরকারের পুরোপুরি অস্বীকার (‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি’—সংসদে সেদিনও এমন মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম আলো, ৩০ জুন) এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতির সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য কোনো তদন্ত না হওয়ায় ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুদকের মামলায় অভিযুক্ত সেতু বিভাগের সচিব আবার সরকারি চাকরিতে ফিরেছেন। এসব বিষয়ের প্রতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোযোগ ও নজর রয়েছে। সব মিলিয়ে সরকার পদ্মা সেতুর ব্যাপারে এমন নতুন কোনো পরিস্থিতি বা বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারেনি, যাতে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নিজের টাকায় সেতু করব (প্রথম আলো, ৩০ জুন)।’ এই যে ‘নিজের টাকায়’ পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, সেখানে ৮০ শতাংশ অর্থই কিন্তু খরচ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের রিজার্ভ থেকেই নিতে হবে এই অর্থ। এখন দেশে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, সেখান থেকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ নেওয়া আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত?

যে রিজার্ভ দিয়ে মাস চারেকের আমদানি বাণিজ্যের বিল পরিশোধ সম্ভব, সেটাকে সাধারণভাবে সন্তোষজনক রিজার্ভ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভকে সেই বিবেচনায় সন্তোষজনক বলা যায়, কিন্তু রিজার্ভের অবস্থা আবার এমনও নয় যে এখান থেকে অর্থ সরানো যায়! সামনে নির্বাচন আসছে—ক্ষমতা পরিবর্তনের এ ধরনের পরিস্থিতিতে রিজার্ভের ওপর প্রভাব পড়ে। সন্তোষজনক অবস্থা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যেতে খুব সময় লাগে না। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচন-পরবর্তী রিজার্ভের ওঠানামার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া যায়। বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রিজার্ভের অবস্থা—এসব বিষয় টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিবেচনার মধ্যেই থাকবে।

কোনো প্রকল্পে কাজ করা অনেক লাভজনক মনে হতে পারে, কিন্তু যেখানে ঝুঁকি আছে, সেখানে কাজ নেওয়ার আগে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিচার-বিবেচনার শেষ থাকে না। স্বচ্ছতা ও তহবিলের নিশ্চয়তা—এই দুটিকে যেকোনো প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয় বলে জানান সাবেক সচিব ও ফিন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্টস গ্রন্থের সহরচয়িতা এম ফাওজুল কবির খান। ‘যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠান কাজ করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা যেমন চাইবে, তেমনি কাজের প্রতিটি পর্যায়ে যথাসময়ে বিল পাওয়ার নিশ্চয়তাও চাইবে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপারেই অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।’

গত ২৭ জুন পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতু নির্মাণের যে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়েছে, তার দলিল সংগ্রহ করা যাবে ৭ জুলাই থেকে। আর জমা দিতে হবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান  দরপত্রে অংশ নেবে বা আদৌ কেউ নেবে কি না, তা এর আগে বলার সুযোগ নেই। মাওয়া ও জাজিরাকে যুক্ত করবে যে পদ্মা সেতু, তার জাজিরা অংশে সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। মাওয়া অংশের কাজও হয়তো খুব শিগগির শুরু হবে। ওপরে যে নানা আশঙ্কার কথা বলা হলো, সেটার ভিত্তি বাস্তব পরিস্থিতি। এই আশঙ্কা ভুল হিসেবে প্রমাণিত হলেই আমরা খুশি হব। তবে তা সত্য হলে পদ্মার দুই পারে সুন্দর দুটি সংযোগ সড়ক নিয়েই আপাতত আমাদের খুশি থাকতে হবে!

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।