সবকিছু ঠিক রাখলে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ

বাংলাদেশে কর্মস্থলে নিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে চট্টগ্রামের জাহাজ প্রস্তুতকারী শিল্প ওয়েস্টার্ন মেরিনের নাম উল্লেখ করা যায়। এই প্রতিষ্ঠান শুধু দেশের জন্যই জাহাজ বানায় না, ডেনমার্ক ও জার্মানিতেও জাহাজ রপ্তানি করে।
ওয়েস্টার্ন মেরিনে যা ঘটেছে, সেখান থেকে সবারই শিক্ষা নেওয়ার আছে: বাংলাদেশ সরকার, দাতা সংস্থা, পোশাক কারখানা, বৈশ্বিক খুচরা বিক্রেতা, সবারই। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিপর্যয় রানা প্লাজা ধসের এক বছর পর পোশাক কারখানাগুলোকে নিরাপদ রাখার জন্য এখান থেকে শিক্ষা নিতেই হবে। রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক মারা যান, আহত হন দুই হাজার ৫১৫ জন।
এ ক্ষেত্রে শিপইয়ার্ড কীভাবে প্রযোজ্য হয়? ২০১১ সালের এই ইয়ার্ডেও তিন হাজার ৫০০ জন শ্রমিকের মধ্যে এক হাজার শ্রমিক আহত হন। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার এরূপ অতি উচ্চহারের কারণগুলো হচ্ছে হেলমেট, বুট, বড় চশমা, মোজা, কান সুরক্ষা ও নানা রকম নিরাপত্তা উপকরণ না থাকা।
এই প্রতিষ্ঠানটি জার্মানিতে জাহাজ রপ্তানি করছে দেখে জার্মান প্রতিষ্ঠান জিআইজেড ২০০৯ সালে জাহাজ আমদানির জন্য এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। একজন ওয়েল্ডার তড়িতাহত হয়ে মারা গেলে একজন আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয় এখানে। এ ছাড়া, শ্রমিকদের নিরাপত্তা-উপকরণ ব্যবহার করতে নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অশিক্ষিত শ্রমিকদের জন্য ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম অতি গরমে চট্টগ্রামের শ্রমিকেরা বুট বা বড় চশমা পরতে অনাগ্রহী ছিলেন। এসব না ব্যবহার করলে জরিমানা এমনকি তাঁদের চাকরিচ্যুতও করা হয়। যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের পুরস্কৃতও করা হয়। ফলে দুর্ঘটনার পরিমাণ ৯৯ শতাংশ কমে আসে, জুন ২০১২ সালের মধ্যে তা মাসে ১০টিতে নেমে আসে, যেটা ছিল মাসে এক হাজার।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই দ্রুত ও অভাবনীয় পরিবর্তনে খুবই সন্তুষ্ট। ক্রেতারাও এতে খুশি।
কোনো আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও ওয়েস্টার্ন মেরিন কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান পুরস্কার ওএইচএসএএস ১৮০০১ লাভ করে। একই সঙ্গে তারা আইএসও ১৪০০১ লাভ করে, পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ। বাংলাদেশে এটা অনন্য। এর ফলে আরও দেশ থেকে তারা কার্যাদেশ পাচ্ছে।
ওয়েস্টার্ন মেরিন ও জিআইজেডের মধ্যকার ৪০ মাসের অংশীদারত্বে প্রথমোক্ত প্রতিষ্ঠান দুই লাখ ৫০ হাজার ও পরেরটি দুই লাখ ৫৬ হাজার ইউরো ব্যয় করেছে উপকরণ ক্রয় ও নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ। ওয়েস্টার্ন মেরিনের জন্য এটা অনেক টাকা। কিন্তু এর ফলে তার শ্রমিকদের চিকিৎসায় ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ অনেক কমেছে, ২০১০ সালে যা ছিল মাসে ১৫ হাজার ইউরো, ২০১২ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৪১ ইউরোতে। কর্মীদের উৎপাদনক্ষমতাও বেড়েছে অনেক। আর এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর তার কাজের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
জিআইজেডের এক প্রতিবেদনে ওয়েস্টার্ন মেরিনের পরিচালক ক্যাপ্টেন আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেছেন, প্রশিক্ষণে টাকা ব্যয় হলেও তা দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করছে, এতে আখেরে লাভই হচ্ছে।
বাংলাদেশে পাঁচ হাজার পোশাক কারখানা থাকলেও এত বছর মাত্র ১৯ জন কারখানা তদারককারী ও সমসংখ্যক অগ্নি ও ভবন তদারককারী আছেন। রানা প্লাজায় এত তলা করার অনুমতি ছিল না। স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে। এটা সমস্যার আরেক দিগন্ত। ভবন পর্যবেক্ষণ অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল, এখানে প্রকৌশল জ্ঞানের দরকার আছে। নির্মাণ উপকরণ ল্যাবে পরীক্ষা করানোর জন্যও টাকা দরকার।
পোশাক কারখানাগুলোর উন্নয়ন খুব জরুরি। রানা প্লাজা ধসের পর বৈশ্বিক ক্রেতা ও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এই লেবেলটার প্রতি মানুষ বিরূপ হয়ে ওঠে। কিন্তু এগুলো উঠে গেলে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। এই শিল্পে ৩৮ লাখ মানুষ নিয়োজিত আছেন, আর দেশের প্রবৃদ্ধি ৬-এর কোঠা ছুঁতে পারে এঁদের কারণেই। দেশের ৮০ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে এ খাত থেকে। আর এর জনশক্তির বেশির ভাগই নারী।
কারখানার চাকরি কিছুটা হলেও নিরাপদ। এর ফলে বহু মানুষ মারাত্মক দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯০ সালের নিরিখে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যুহার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে পেরেছে দেশটি, জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী।
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের এক এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা

বলে এই বৈপরীত্যের স্বরূপ বোঝা গেল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ঘনবসতিপূর্ণ ১৫৩ মিলিয়ন মানুষের দেশ, এ দেশের মানুষ সব সময় বিপদের মুখে থাকে। পোশাক কারখানা এখান থেকে উঠে গেলে এই মানুষগুলো ‘না খেয়ে মরবে’।
এ দেশের সামনে হুমকি হচ্ছে, কীভাবে এখানে অর্থপূর্ণভাবে ও টেকসইভাবে সীমিত সম্পদ নিয়ে কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বাতিল করলে সরকার জাতীয় ত্রিপক্ষীয় একটি চুক্তি করেছে ভবনগুলোর নিরাপত্তাবিধান ও অগ্নিকাণ্ড থেকে সুরক্ষায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তা বাতিল করার হুমকি দিয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় পোশাক ক্রেতা ও দাতা সংস্থাগুলো ৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি তহবিল গঠন করেছে, আহত ও নিহত শ্রমিকদের জন্য। এর মধ্যে ব্র্যাক ইউএসএও আছে, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মার্কিন শাখা। বাংলাদেশ সরকার ও আইএলও গত অক্টোবরে ২৪ দশমিক ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশ্বাস দিয়েছে, কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য।
কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত, অগ্নিকাণ্ড থেকে সুরক্ষা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতির জন্য বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলেছে, একই সঙ্গে বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গেও তারা কাজ করতে চায়। এদিকে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্র্যান্ড যেমন গ্যাপ, ওয়ালমার্ট ও টার্গেট—এরা আলাদা জোট করেছে। এরা বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার ৮৯৪টি কারখানায় কাজ করিয়ে নেয়, তবে এর মধ্যে কারখানাগুলো কর্তৃক নিয়োজিত উপ-ঠিকাদারদের গণনার মধ্যে ধরা হয়নি। এটা একটা বড় বাধা।
এই জোটটির একটি আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। তাদের আমদানির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে তারা প্রতিবছর সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ডলার চাঁদা দেবে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৩৮টি আন্তর্জাতিক আগুন, তড়িৎ ও কাঠামোগত প্রকৌশলীর দল এক হাজার ৫০০টি কারখানা পর্যবেক্ষণ করবে। এর মধ্যে প্রায় ৭০০টি কারখানা পরিদর্শন তারা শেষ করেছে। কিছু কিছু কারখানা উন্নয়নের জন্য সেগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে তারা। সে সময় শ্রমিকদের ওই তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হবে।
এর পাশাপাশি চার লাখ কারখানা ব্যবস্থাপক ও শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, জুলাই ২০১৪-এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখকে এই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার কথা রয়েছে। এই জোট আরও ৫০টি কারখানায় শ্রমিক হেল্পলাইন স্থাপন করছে, ২০১৪ সালের জুলাই মাসের মধ্যে আরও প্রায় ১৫০ কারখানায় তা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকারি পরিদর্শকদের অভাবই প্রশিক্ষণ ভালোভাবে করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। তাঁদের বেতন কম, পরিবহন-সুবিধা সীমিত। যানজটের ঢাকা শহরে তা এক বাধাই। সম্প্রতি জিআইজেড ২০টি মোটরসাইকেল দিয়েছে। উন্নত দেশে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকে, উন্নয়নশীল দেশে তা সম্ভব নয়। যেমন এই পরিদর্শকেরা কারখানায় গিয়ে গুনতেন কতগুলো আগুন সতর্কতামূলক বেল আছে, সেগুলো কাজ করে কি না, তা আর দেখার অবকাশ তাঁদের ছিল না।
টাকা বড় কথা নয়। সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ও মানসিকতা পরিবর্তনই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। প্রশিক্ষকেরা আসছেন, তাঁরা দেখিয়ে দিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো আরও সহজ ও যোগাযোগমুখী হলে শ্রমিকেরা সহজেই তা শিখতে পারবেন। জিআইজেড নারীদের জন্য ৪৫টি ক্যাম্প স্থাপন করেছে। সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
পরিবর্তন আসতেই পারে, এটা অসম্ভব কিছু নয়। এই দেশেই ঘূর্ণিঝড় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী রূপ নিয়েছে, গ্রামের স্বেচ্ছাসেবীরাই তা পরিচালনা করছেন। একজন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিদর্শক আমাকে বলেছেন, গ্যাস স্টেশনে কয়বার আগুন লেগেছে বলে আপনি শুনেছেন? সেখানে খুব কমই তা হয়। এমনকি বাংলাদেশেও, কারণ সেখানেও উচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাহলে পোশাক কারখানায়ও কেন নয়?

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
অ্যামি ইয়ে: নয়াদিল্লিতে কর্মরত আমেরিকান সাংবাদিক।